কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্কসবাদী) বা সিপিআই(এম)-এর পতনের পিছনে প্রধান কারণ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায় দলের সমর্থনের ভিত্তি ক্ষয়কে চিহ্নিত করেছেন দলের প্রবীণ নেতা প্রকাশ কারাত (Prakash Karat)। তিনি জানিয়েছেন, আগামী অল-ইন্ডিয়া কংগ্রেসে দলের শক্তি পুনর্গঠনের জন্য একটি রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনা হবে। ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সিপিআই(এম)-এর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকারী কারাত আরও বলেছেন, ১৯৯৬ সালে দলের প্রবীণ নেতা জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী পদ প্রত্যাখ্যানকে তিনি দলের পতনের কারণ হিসেবে বিবেচনা করেন না।
পিটিআই-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কারাত বলেন, “এটা সত্য যে দলের স্বাধীন শক্তি এবং প্রভাব বৃদ্ধি পায়নি। এর মূল কারণ হল পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায় আমাদের সমর্থনের ভিত্তির ক্ষয়, যে দুটি রাজ্য আমাদের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল।” এই মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি দলের বর্তমান সংকটের মূল কারণটি স্পষ্ট করেছেন, যা দীর্ঘদিন ধরে বামপন্থী রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত দুটি রাজ্যে দলের প্রভাব হ্রাসের দিকে ইঙ্গিত করে।
পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম)-এর পতন
পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম)-এর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট ১৯৭৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল। এই দীর্ঘ সময় ধরে দলটি রাজ্যের গ্রামীণ ও শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক এবং কৃষকদের মধ্যে গভীর সমর্থন গড়ে তুলেছিল। কিন্তু ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে ক্ষমতা হারানোর পর থেকে দলটির প্রভাব ক্রমাগত কমতে শুরু করে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট মাত্র ২টি আসন পায়, যেখানে ২০০৪ সালে তারা ৩৫টি আসন জিতেছিল। বর্তমানে রাজ্যে দলটির কোনও বিধায়ক বা লোকসভার সাংসদ নেই, যা এর অস্তিত্বের সংকটকে আরও স্পষ্ট করে।
কারাতের মতে, এই পতনের পিছনে জ্যোতি বসুর ১৯৯৬ সালের সিদ্ধান্তের কোনও ভূমিকা নেই। ১৯৯৬ সালে ইউনাইটেড ফ্রন্ট সরকার গঠনের সময় বামপন্থী দলগুলি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে জ্যোতি বসুকে প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু দলের কেন্দ্রীয় কমিটি এই প্রস্তাবে সম্মতি দেয়নি, এবং বসু নিজেও এই পদ গ্রহণ করেননি। অনেকে মনে করেন, এই সিদ্ধান্ত দলের জন্য একটি মিসড অপরচুনিটি ছিল, যা জাতীয় রাজনীতিতে সিপিআই(এম)-এর প্রভাব বাড়াতে পারত। তবে কারাত এই তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী পদ প্রত্যাখ্যান দলের পতনের কারণ নয়। আমাদের পতনের মূল কারণ আমাদের শক্তিশালী রাজ্যগুলিতে সমর্থন হ্রাস।”
ত্রিপুরায় বামের ভাঙন
ত্রিপুরাও সিপিআই(এম)-এর আরেকটি শক্ত ঘাঁটি ছিল। ১৯৯৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মানিক সরকারের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট রাজ্যটিতে ক্ষমতায় ছিল। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং সামাজিক কল্যাণে ত্রিপুরা বাম শাসনের একটি উদাহরণ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এই রাজ্যে ক্ষমতা দখল করে, যা বামপন্থীদের জন্য একটি বড় ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হয়। কারাতের মতে, এই দুটি রাজ্যে সমর্থন হ্রাসই দলের জাতীয় প্রভাব কমে যাওয়ার প্রধান কারণ।
ত্রিপুরায় বিজেপির উত্থানের পিছনে স্থানীয় বিরোধী দলগুলির সঙ্গে জোট এবং আর্থিক শক্তির ব্যবহারকে দায়ী করা হয়। বামপন্থীরা অভিযোগ করেছেন, বিজেপি অর্থের জোরে এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে ত্রিপুরায় তাদের ঘাঁটি দখল করেছে। এই পরিস্থিতি দলের জন্য একটি শিক্ষা হওয়া উচিত বলে মনে করেন কারাত।
পুনর্গঠনের রোডম্যাপ
কারাত জানিয়েছেন, আগামী অল-ইন্ডিয়া কংগ্রেসে দলের পুনর্গঠনের জন্য একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হবে। তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হবে পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায় হারানো জমি পুনরুদ্ধার করা এবং জাতীয় স্তরে দলের প্রভাব বাড়ানো।” এই কংগ্রেসে নতুন নেতৃত্বের উত্থান এবং তরুণদের দলে যুক্ত করার উপরও জোর দেওয়া হবে। বর্তমানে কেরলই সিপিআই(এম)-এর একমাত্র শক্তিশালী রাজ্য, যেখানে পিনারাই বিজয়নের নেতৃত্বে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এলডিএফ) ক্ষমতায় রয়েছে। তবে, কারাত মনে করেন, শুধু কেরলের উপর নির্ভর করে দলের জাতীয় প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখা সম্ভব নয়।
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির বিরুদ্ধে বামপন্থীদের একটি বিকল্প শক্তি হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। কারাত বলেন, “তৃণমূলের বিকল্প বিজেপি হতে পারে না, এবং বিজেপির বিকল্প তৃণমূল নয়। আমাদের লক্ষ্য হবে বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির একটি নতুন জোট গড়ে তোলা।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, বিজেপির সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা এবং তৃণমূলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দলকে আরও সক্রিয় হতে হবে।
কারাতের এই মন্তব্য বামপন্থী সমর্থকদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। অনেকে মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গে দলের পুনরুত্থান সম্ভব যদি তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করা যায় এবং স্থানীয় সমস্যাগুলির উপর জোর দেওয়া হয়। তবে, কিছু সমালোচক মনে করেন, দলের পুরনো নীতি এবং আদর্শবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক ভারতের রাজনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তারা বলছেন, সিপিআই(এম)-কে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে বদলাতে হবে।
প্রকাশ কারাতের সাক্ষাৎকারে সিপিআই(এম)-এর বর্তমান সংকট এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার একটি স্পষ্ট চিত্র উঠে এসেছে। জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী পদ প্রত্যাখ্যান নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্ককে তিনি অস্বীকার করেছেন এবং দলের পতনের জন্য পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় সমর্থন হ্রাসকে দায়ী করেছেন। আগামী কংগ্রেসে দলটি কীভাবে নিজেকে পুনর্গঠন করে এবং হারানো জমি ফিরে পায়, তা দেখার বিষয়। বামপন্থীদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়, যেখানে তারা কেবল কেরল নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও তাদের প্রাসঙ্গিকতা ফিরিয়ে আনতে চায়।