দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক মঞ্চে ফের একবার উত্তেজনার পারদ চড়েছে। পহেলগাঁওয়ে সাম্প্রতিক হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন নতুন মাত্রা পেয়েছে। পহেলগাঁওয়ের বদলা নিতে ভারত গতকাল রাতে অপারেশন সিঁদুরের মধ্যে দিয়ে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের ৯ টি জায়গায় পাক জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করেছে।
এই পরিস্থিতিতে চিন (china), যিনি পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের মিত্র এবং ভারতের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার, প্রথমবারের মতো মুখ খুলেছেন।
চিনের (china) পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইসাক দারের সঙ্গে ফোনে কথোপকথনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং উভয় দেশকে সংযমী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “আমরা পরস্পরের প্রতিবেশী।এমন কিছু করা উচিত নয়, যা আমাদের অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে বিঘ্নিত করে।”
পহেলগাঁওয়ে হামলা ও ভারতের প্রতিক্রিয়া
পাকিস্তানের জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁও সাম্প্রতিক হামলায় বেশ কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মী ও বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়েছেন। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তান-ভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলিকে দায়ী করেছে এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া হিসেবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সীমিত সামরিক অভিযান (স্ট্রাইক) চালিয়েছে।
ভারতের দাবি, এই অভিযান ছিল জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করার লক্ষ্যে এবং এটি একটি প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানিয়েছেন, “আমরা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতার নীতি অনুসরণ করি। পাকিস্তানের মাটিতে সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেওয়া হলে, আমরা নীরব থাকব না।”
এই অভিযানের পর পাকিস্তান তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, “ভারতের এই আগ্রাসন পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এই বিষয়ে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানাচ্ছি।” এই ঘটনার পর দুই দেশের মধ্যে সীমান্তে উত্তেজনা বেড়েছে এবং সামরিক প্রস্তুতি জোরদার হয়েছে।
চেনা জার্সি ছেড়ে চেন্নাইয়ের বিরুদ্ধে নতুন জার্সি কেন পরবে কেকেআর? জানুন কারণ
চিনের মধ্যস্থতামূলক অবস্থান (china)
চিনের (china) পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এই সংঘাতের প্রেক্ষিতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে ফোনালাপে হামলার নিন্দা করেছেন এবং একটি নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। তবে তিনি সরাসরি ভারতের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর মন্তব্য করেননি।
পরিবর্তে, তিনি উভয় দেশকে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে এবং শান্তি বজায় রাখতে উৎসাহিত করেছেন। ওয়াং ই বলেছেন, “দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতা আমাদের সকলের স্বার্থে। উভয় দেশের উচিত সংযম প্রদর্শন করা এবং এমন কোনো পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকা, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।”
চিনের (china) এই অবস্থান কূটনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, চিন একদিকে পাকিস্তানের প্রতি তার দীর্ঘদিনের মৈত্রী বজায় রাখতে চাইছে, অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে তার বাণিজ্যিক ও কৌশলগত সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করতে চাইছে।
চিন (china) ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার, এবং দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ বিলিয়ন ডলারে পরিমাপ করা হয়। তবে, চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (CPEC) এবং সামরিক সহযোগিতার মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে চিনের সম্পর্ক আরও গভীর। এই দ্বৈত ভূমিকা চিনকে একটি জটিল অবস্থানে ফেলেছে।
চিন-পাকিস্তান সম্পর্ক ও সামরিক সহযোগিতা
চিন (china) ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। চিন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ, উপগ্রহ প্রযুক্তি, গোয়েন্দা তথ্য এবং নজরদারি ব্যবস্থায় সহায়তা করে। পাকিস্তান বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে চিনের বাইডু স্যাটেলাইট সিস্টেম ব্যবহার করছে, যা সামরিক অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া, চিন আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানকে সমর্থন করে। উদাহরণস্বরূপ, সন্ত্রাসে অর্থায়নবিরোধী সংস্থা FATF-এ পাকিস্তানকে কালো তালিকাভুক্ত হওয়া থেকে রক্ষা করতে চিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
সাম্প্রতিক একটি পোস্টে দাবি করা হয়েছে, চিন (china) পাকিস্তানকে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে, ভারত যদি পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে কোনো সামরিক পদক্ষেপ নেয়, তবে চিন পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াবে। যদিও এই দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত হয়নি, তবে এটি চিনের কৌশলগত অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়। চিন সম্প্রতি ভারতের কাছাকাছি এলাকায় সামরিক মহড়া শুরু করেছে, যা ভারতের জন্য একটি সতর্কবার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ভারত-চিন সম্পর্কের প্রেক্ষাপট
ভারত ও চিনের মধ্যে সম্পর্ক বরাবরই জটিল। ১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক লাদাখ সংঘর্ষ পর্যন্ত, দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ এবং কৌশলগত প্রতিযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। ২০২০ সালের গালওয়ান উপত্যকার সংঘর্ষে উভয় পক্ষের সেনা হতাহত হয়েছিল, যা দুই দেশের সম্পর্কে বড় ধরনের ধাক্কা হিসেবে কাজ করেছিল।
এরপর থেকে ভারত চিনা পণ্যের উপর নির্ভরতা কমাতে এবং দেশীয় শিল্পকে উৎসাহিত করতে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগকে জোর দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারত গত চার বছরে চিন থেকে খেলনা আমদানি ৮০ শতাংশ কমিয়েছে।
তবে, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও, ভারত ও চিন কূটনৈতিকভাবে সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে। সম্প্রতি পূর্ব লাদাখে টহল সংক্রান্ত একটি চুক্তি দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমানোর প্রচেষ্টার ইঙ্গিত দেয়। এই প্রেক্ষিতে, চিনের সাম্প্রতিক বিবৃতি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষার একটি প্রয়াস হিসেবে দেখা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই সংঘাতের প্রতি নিবিড়ভাবে নজর রাখছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং জাতিসংঘ সংযমের আহ্বান জানিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, চিনের মধ্যস্থতামূলক অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব বজায় রাখার কৌশলের অংশ। তবে, যদি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত তীব্র হয়, তবে চিনকে তার অবস্থান আরও স্পষ্ট করতে হবে, যা তার ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
চিনের সাম্প্রতিক বিবৃতি এবং কৌশলগত পদক্ষেপ দক্ষিণ এশিয়ার জটিল ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতার প্রতিফলন। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে চিন কূটনৈতিকভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে, এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য উভয় দেশের সংযম এবং আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের প্রতি প্রতিশ্রুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।