রাজনাথের প্রস্তাবে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত শান্তি ও আলোচনায় প্রস্তুত চিন

চিন সোমবার (৩০ জুন, ২০২৫) জানিয়েছে যে ভারতের সঙ্গে তার সীমান্ত (India Border) বিরোধ অত্যন্ত জটিল এবং এটি সমাধানে সময় লাগবে।  তবে, একই সঙ্গে চিন…

China Acknowledges Complex India Border Dispute, Open to Delimitation Talks

চিন সোমবার (৩০ জুন, ২০২৫) জানিয়েছে যে ভারতের সঙ্গে তার সীমান্ত (India Border) বিরোধ অত্যন্ত জটিল এবং এটি সমাধানে সময় লাগবে।  তবে, একই সঙ্গে চিন সীমান্তের পরিসীমন (ডিলিমিটেশন) নিয়ে আলোচনা এবং সীমান্তে শান্তি বজায় রাখতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছে। এই মন্তব্য এসেছে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সাম্প্রতিক বিবৃতির প্রেক্ষিতে, যিনি গত ২৬ জুন চিনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাডমিরাল ডং জুনের সঙ্গে কিংদাওতে শাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) সম্মেলনের প্রান্তে একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। এই বৈঠকে রাজনাথ সিং ভারত ও চিনের মধ্যে দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধ সমাধানের জন্য একটি কাঠামোগত রোডম্যাপের মাধ্যমে উত্তেজনা হ্রাস এবং সীমান্ত নির্ধারণের প্রক্রিয়া পুনরুজ্জীবিত করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

রাজনাথ সিংয়ের প্রস্তাব ও বৈঠকের পটভূমি
কিংদাওতে এসসিও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের সম্মেলনের প্রান্তে রাজনাথ সিং এবং ডং জুনের মধ্যে হওয়া এই বৈঠকটি ছিল ভারত ও চিনের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে সর্বোচ্চ স্তরের সামরিক আলোচনা। বৈঠকের মূল ফোকাস ছিল লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি) বরাবর শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। রাজনাথ সিং জোর দিয়ে বলেছেন যে উভয় দেশের উচিত “জটিল সমস্যা” সমাধানের জন্য একটি পরিকল্পিত পদ্ধতি গ্রহণ করা এবং সীমান্ত নির্ধারণের জন্য বিদ্যমান প্রক্রিয়াকে পুনরুজ্জীবিত করা। তিনি ২০২০ সালে পূর্ব লাদাখে সামরিক সংঘর্ষের পর সৃষ্ট আস্থার ঘাটতি দূর করার জন্য বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার উপরও জোর দিয়েছেন। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি অনুযায়ী, উভয় মন্ত্রী সেনা প্রত্যাহার, উত্তেজনা হ্রাস, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এবং চূড়ান্ত পরিসীমনের বিষয়ে অগ্রগতি অর্জনের জন্য পরামর্শ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছেন।

   

চিনের প্রতিক্রিয়া
রাজনাথ সিংয়ের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় চিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং বলেন, “ভারত ও চিন সীমান্ত প্রশ্নে বিশেষ প্রতিনিধি (এসআর) প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করেছে এবং চিন-ভারত সীমান্ত প্রশ্ন নিষ্পত্তির জন্য রাজনৈতিক পরামিতি ও নির্দেশক নীতিমালার উপর একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে।” তিনি আরও জানান যে উভয় দেশ বিভিন্ন স্তরে কূটনৈতিক এবং সামরিক যোগাযোগের ব্যবস্থা বজায় রেখেছে। “চিন ভারতের সঙ্গে পরিসীমন আলোচনা এবং সীমান্ত ব্যবস্থাপনা সহ বিভিন্ন বিষয়ে যোগাযোগ বজায় রাখতে প্রস্তুত, যৌথভাবে সীমান্ত এলাকায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং আন্তঃসীমান্ত বিনিময় ও সহযোগিতা উন্নীত করতে,” মাও নিং যোগ করেন।

তবে, ২৩টি এসআর-স্তরের আলোচনা সত্ত্বেও সীমান্ত সমস্যার সমাধানে দীর্ঘস্থায়ী বিলম্ব নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মাও নিং বলেন, “সীমান্ত প্রশ্নটি জটিল, এবং এটি নিষ্পত্তি করতে সময় লাগবে।” তিনি ইতিবাচক দিক হিসেবে উল্লেখ করেন যে উভয় দেশ ইতিমধ্যেই বিভিন্ন স্তরে যোগাযোগের জন্য প্রক্রিয়া স্থাপন করেছে। তিনি আরও আশা প্রকাশ করেন যে ভারত চিনের সঙ্গে একই দিকে কাজ করবে, প্রাসঙ্গিক বিষয়ে যোগাযোগ অব্যাহত রাখবে এবং যৌথভাবে সীমান্ত এলাকায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে।

ইতিহাস ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
ভারত ও চিনের মধ্যে ৩,৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এলএসি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অচিহ্নিত এবং বিতর্কিত। এই সীমান্তে উভয় দেশের ভিন্ন ভিন্ন ধারণার কারণে প্রায়ই দুই দেশের সেনা মুখোমুখি হয়, যা উত্তেজনার সৃষ্টি করে। ১৯৬২ সালে উভয় দেশের মধ্যে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ হয়েছিল, এবং এরপর ১৯৮৬ সালে সুমদ্রং চু, ২০১৩ সালে দেপসাং, ২০১৪ সালে চুমুর, ২০১৭ সালে ডোকলাম এবং ২০২০ সালে পূর্ব লাদাখে একাধিক সামরিক সংঘর্ষ হয়েছে। ২০২০ সালের গালওয়ান সংঘর্ষের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল, যা এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। তবে, গত বছর অক্টোবরে দেপসাং এবং ডেমচকে সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন হওয়ায় দুই বছরের আলোচনার অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে।

গত ডিসেম্বরে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল এবং চিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ের মধ্যে বেইজিংয়ে এসআর-স্তরের ২৩তম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যা ২০২০ সালের পর প্রথম এই ধরনের বৈঠক ছিল। এই বৈঠকটি দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার দিকে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়।

Advertisements

অন্যান্য উন্নয়ন
সীমান্ত আলোচনার পাশাপাশি, সম্প্রতি ভারত ও চিনের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে কৈলাস মানসরোবর তীর্থযাত্রা পুনরায় শুরু হয়েছে, যা ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারী এবং পরবর্তীতে সীমান্ত উত্তেজনার কারণে বন্ধ ছিল। এছাড়া, দুই দেশ সরাসরি বিমান যোগাযোগ পুনরায় শুরু করার বিষয়ে আলোচনায় নিয়োজিত রয়েছে। এই পদক্ষেপগুলি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতির দিকে ইঙ্গিত করে, তবে সীমান্ত বিরোধের স্থায়ী সমাধান এখনও অধরা রয়ে গেছে।

চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
ভারত ও চিনের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ সমাধানের পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। চিন বারবার বলে আসছে যে সীমান্ত বিষয়টি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সামগ্রিক কাঠামোর উপর প্রভাব ফেলবে না। তবে, ভারতের অবস্থান হলো, সীমান্ত সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সম্পর্ক পুরোপুরি স্বাভাবিক হবে না। রাজনাথ সিংয়ের প্রস্তাবিত চার-দফা রোডম্যাপে সেনা প্রত্যাহার, উত্তেজনা হ্রাস, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এবং পরিসীমনের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এলএসি-র সুনির্দিষ্ট সীমানা নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত দুই দেশের সেনার মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষের সম্ভাবনা থাকবে। অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল ডিএস হুডা বলেন, “উভয় পক্ষের উচিত এলএসি নির্ধারণ করা, যাতে লাদাখ এবং অরুণাচল প্রদেশের বিতর্কিত এলাকায় মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়ানো যায়।”

ভারত-চিন সীমান্ত বিরোধ একটি জটিল এবং দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা, যা সমাধানে সময় এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টার প্রয়োজন। রাজনাথ সিংয়ের সাম্প্রতিক প্রস্তাব এবং চিনের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া এই বিষয়ে আশার আলো দেখাচ্ছে। তবে, ২৩টি এসআর-স্তরের আলোচনার পরও কোনো ব্যাপক সমাধান না হওয়ায় উভয় দেশের ধৈর্য ও প্রতিশ্রুতি পরীক্ষা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে দুই দেশের মধ্যে আরও ফলপ্রসূ আলোচনা এবং পারস্পরিক সহযোগিতা এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পথ প্রশস্ত করতে পারে।