ট্রাম্পের শুল্ক বৃদ্ধিতে ‘শাপে বর’! বিশ্লেষণ BRICS চেয়ারম্যানের

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের উপর অতিরিক্ত ২৫% শুল্ক (BRICS)আরোপের ঘোষণা করার পর এই বিষয়ে BRICS চেম্বার অফ কমার্স এর চেয়ারম্যান হরবংশ চাওলা একটি গুরুত্বপূর্ণ…

BRICS analysis

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের উপর অতিরিক্ত ২৫% শুল্ক (BRICS)আরোপের ঘোষণা করার পর এই বিষয়ে BRICS চেম্বার অফ কমার্স এর চেয়ারম্যান হরবংশ চাওলা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় ৮৮-৯০% মার্কিন ডলারে হয়। তাই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমেরিকার গুরুত্ব অপরিসীম।

তবে, এটাও মনে রাখতে হবে যে, BRICS দেশগুলি বিশ্বের ৪৬% জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করে। বিশ্বের তেল উৎপাদনের প্রায় ৪৪% এই দেশগুলি থেকে আসে। BRICS দেশগুলির মধ্যে ৩০ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি বাণিজ্য হচ্ছে। তাই BRICS দেশগুলিকে উপেক্ষা করা যায় না।

   

আমার ব্যক্তিগত মতামত এবং BRICS এর চেয়ারম্যান হিসেবে বলছি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবংআমেরিকা এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করছে, যার ফলে BRICS দেশগুলি আরও দ্রুত এবং সুস্থভাবে ঐক্যবদ্ধ হবে।

আমরা যে বিষয়গুলি আগামী ১৫-২০ বছরে প্রত্যাশা করেছিলাম, তা এখন মনে হচ্ছে আগামী এক বছরের মধ্যেই ঘটে যাবে।” এই বিবৃতি ভারত-আমেরিকা বাণিজ্য সম্পর্ক এবং BRICS-এর ভূমিকা নিয়ে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

আমেরিকার শুল্ক আরোপের পটভূমি

২০২৫ সালের ৩০ জুলাই, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভারতের উপর ২৫% শুল্ক আরোপের ঘোষণা করেন, যা ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হয়। এই শুল্কের পাশাপাশি ভারতের রাশিয়া থেকে জ্বালানি এবং সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্য একটি “অতিরিক্ত জরিমানা” শুল্কের কথাও বলা হয়েছে, যার বিস্তারিত এখনও স্পষ্ট নয়।

ট্রাম্প এই শুল্ক আরোপের জন্য ভারতের উচ্চ শুল্ক হার, অ-মুদ্রাগত বাণিজ্য বাধা এবং BRICS সদস্যপদকে দায়ী করেছেন। তিনি BRICSকে “মার্কিন ডলারের বিরুদ্ধে আক্রমণ” হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যা তাঁর মতে মার্কিন অর্থনৈতিক আধিপত্যের জন্য হুমকি। ২০২৪-২৫ সালে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ১৩১.৮৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।

উভয় দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে এটিকে ৫০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়েছে। তবে, এই শুল্ক আরোপ ভারতের রফতানি খাত, বিশেষ করে ফার্মাসিউটিক্যাল, রত্ন ও গহনা, টেক্সটাইল এবং অটোমোবাইল শিল্পের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

হরবংশ চাওলার বিবৃতি

BRICS চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির চেয়ারম্যান হরবংশ চৌলা এই শুল্ক আরোপকে যুক্তরাষ্ট্রের “চাপ সৃষ্টির কৌশল” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, “এই শুল্ক বৃদ্ধি স্পষ্টতই ভারতকে আমেরিকার সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষরে বাধ্য করার একটি কৌশল।” তিনি আরও জানান,BRICS দেশগুলি বিশ্বের অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যাগত দৃষ্টিকোণ থেকে উপেক্ষা করার মতো নয়।

তিনি উল্লেখ করেন, BRICS দেশগুলির মধ্যে বাণিজ্য, বিশেষ করে স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য ব্যবস্থা, মার্কিন ডলারের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ না করে বাণিজ্যের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করছে। তাঁর মতে, ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ বিআরআইসিএস দেশগুলিকে আরও দ্রুত ঐক্যবদ্ধ হতে উৎসাহিত করবে, যা আগামী এক বছরের মধ্যে তাদের অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।

Advertisements

ভারতের প্রতিক্রিয়া

ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় এই শুল্ক আরোপের প্রভাব বিশ্লেষণ করছে এবং জানিয়েছে যে, ভারত একটি “ন্যায্য, সুষম এবং পারস্পরিক সুবিধাজনক” দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল জানিয়েছেন, কৃষি, দুগ্ধ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এমএসএমই) খাতে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত রাখা হবে। ভারত ইতিমধ্যে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়ম অনুযায়ী প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপের অধিকার সংরক্ষণ করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম শুল্কের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে।

BRICS-এর ক্রমবর্ধমান প্রভাব

হরবংশ চাওলার বিবৃতি BRICS-এর ক্রমবর্ধমান প্রভাবের উপর আলোকপাত করেছে। BRICS (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা) এবং সম্প্রতি যুক্ত হওয়া বিআরআইসিএস প্লাস দেশগুলি (মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া) বিশ্ব অর্থনীতির ৩১.৫% এবং বিশ্বের ৪০% জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করে।

ভারত ২০২৬ সালে BRICS-এর চেয়ারম্যানশিপ গ্রহণ করবে, এবং চৌলা মনে করেন, এই শুল্ক আরোপ BRICS দেশগুলির মধ্যে সহযোগিতাকে ত্বরান্বিত করবে। তিনি বলেন, ভারতের রুপি-ভিত্তিক বাণিজ্য ব্যবস্থা, যেমন রাশিয়ার সঙ্গে ২০২২ সাল থেকে চালু ব্যবস্থা, মার্কিন ডলারের বিরুদ্ধে নয়, বরং বাণিজ্যের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার জন্য গৃহীত হয়েছে।

অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব

এই শুল্ক আরোপ ভারতের রফতানি খাতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যার মধ্যে প্রায় ৮৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি ঝুঁকির মুখে রয়েছে। বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন যে, এটি ভারতের জিডিপি বৃদ্ধিকে ৩০ বেসিস পয়েন্ট পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে।

তবে, ভারতের অভ্যন্তরীণ চাহিদা-চালিত অর্থনীতি এই প্রভাব কিছুটা প্রশমিত করতে পারে। ভারত বিকল্প বাজার, যেমন মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং বিআরআইসিএস দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধির মাধ্যমে এই শুল্কের প্রভাব মোকাবিলার পরিকল্পনা করছে।

হরবংশ চাওলার বিবৃতি ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য সম্পর্ক এবং বিআরআইসিএস-এর ভূমিকা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ বিআরআইসিএস দেশগুলির মধ্যে সহযোগিতাকে ত্বরান্বিত করতে পারে, যা ভারতের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন এবং অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে।

ভারত এখন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, তবে জাতীয় স্বার্থ এবং কৃষক ও ক্ষুদ্র শিল্পের সুরক্ষাকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কূটনীতির জটিলতা এবং ভারতের কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখার চ্যালেঞ্জকে তুলে ধরেছে।