লোকসভায় বুধবার এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যখন কেন্দ্রীয় সরকার তিনটি বিতর্কিত বিল পেশ করে (Bill To Remove PM)। প্রস্তাবিত এই বিলগুলিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে—যদি প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, কোনো মুখ্যমন্ত্রী, অথবা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের কোনো মন্ত্রী গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে টানা ৩০ দিন জেলে থাকেন, তবে তাঁকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পদচ্যুত করা হবে।
এই যুগান্তকারী বিধানকে কেন্দ্র করেই চরম হট্টগোলের সৃষ্টি হয় সংসদে। কড়া কণ্ঠে বিরোধীরা এর তীব্র বিরোধিতা করেন এবং “বিল ওয়াপস লো!” স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে লোকসভার অধিবেশন কক্ষ।
কোন কোন বিল পেশ করা হলো?
বুধবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সংসদে একসঙ্গে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিল পেশ করেন—
1. Government of Union Territories (Amendment) Bill, 2025
2. Constitution (130th Amendment) Bill, 2025
3. Jammu and Kashmir Reorganisation (Amendment) Bill, 2025
এই তিনটি বিলের অন্যতম মূল উদ্দেশ্য হলো—অপরাধ ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত উচ্চপদস্থ রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া এবং আইন ও শাসনের শুদ্ধতা বজায় রাখা।
প্রস্তাবিত বিলগুলিতে বলা হয়েছে—
কোনো জনপ্রতিনিধি গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে যদি বিচারাধীন অবস্থায় টানা ৩০ দিন জেলে কাটান, তবে তিনি আর সরকারি পদে বহাল থাকতে পারবেন না।
এটি কেবলমাত্র সাংবিধানিক পদধারী মন্ত্রীদের জন্য নয়; প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় বা রাজ্য পর্যায়ের মন্ত্রী, এমনকি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মন্ত্রীর ক্ষেত্রেও এই বিধান প্রযোজ্য হবে।
৩০ দিনের সীমা পার হলেই পদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে খালি হয়ে যাবে। এরপর নতুন নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হবে।
এই প্রস্তাবিত বিধানকে ‘সংবিধান বিরোধী’ এবং ‘অগণতান্ত্রিক’ আখ্যা দিয়ে কংগ্রেসসহ বিভিন্ন বিরোধী দল তীব্র প্রতিবাদে সরব হয়।
লোকসভার অধিবেশনে তীব্র স্লোগান, টেবিল চাপড়ানো, এবং প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
অধিবেশন কয়েক দফা মুলতুবিও করতে হয়।
বিরোধী দলের অন্যতম মুখ্য অভিযোগ হলো—এই আইনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে কেন্দ্র সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কারাবন্দি করে সরাসরি পদচ্যুত করার সুযোগ পাবে। এতে গণতান্ত্রিক কাঠামো দুর্বল হবে এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার রাজনীতি আরও তীব্র হবে।
কংগ্রেস নেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরী সংসদে বলেন, “এটি আসলে গণতন্ত্রের জন্য এক কালো দিন। সরকার বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে জোরপূর্বক পদ থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে। এটি জনমতের উপর সরাসরি আঘাত।”
তৃণমূল কংগ্রেসের সৌগত রায়ও এই প্রস্তাবের সমালোচনা করে বলেন, “মাত্র ৩০ দিনে বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হয় না। জেল হাজত মানেই অপরাধ প্রমাণ নয়। তাহলে কেন এত তাড়াহুড়ো করে পদ খালি করার শর্ত জুড়ে দেওয়া হচ্ছে?”
অমিত শাহ এই বিলগুলির পক্ষে সাফাই দিয়ে সংসদে বলেন, “দেশের গণতন্ত্র ও প্রশাসনকে দুর্নীতি ও অপরাধমুক্ত রাখা আমাদের দায়িত্ব। কোনো ব্যক্তি গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে দীর্ঘদিন জেলে থাকলে তিনি জাতির সেবা করার যোগ্য নন। তাই এই পদক্ষেপ প্রয়োজনীয়।”
তিনি আরও দাবি করেন, এই প্রস্তাব দেশের মানুষের স্বচ্ছ রাজনীতির দাবিকে পূরণ করবে এবং প্রশাসনিক শুদ্ধতা বাড়াবে।
তৃতীয় বিল Jammu and Kashmir Reorganisation (Amendment) Bill, 2025 বিশেষভাবে জম্মু-কাশ্মীরের প্রশাসনিক কাঠামোতে পরিবর্তন আনবে বলে জানা গেছে। বিলটিতে শাসন ব্যবস্থায় আরও কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত রাজনৈতিক নেতাদের দ্রুত পদচ্যুত করার বিধান রাখা হয়েছে।
আইন বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, বিলটি দুর্নীতি ও অপরাধ দমনে কার্যকর হলেও বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই পদচ্যুতির বিধান গুরুতর প্রশ্নের জন্ম দেয়। কারণ ‘অভিযুক্ত’ মানেই অপরাধী নয়। এভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া জনগণের রায়কে অসম্মান করা হতে পারে।
অন্যদিকে, কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করছেন—রাজনীতির অপরাধীকরণ রোধ করতে কঠোর আইন প্রয়োজন। এই বিল রাজনৈতিক নেতাদের কাছে এক ধরনের সতর্কবার্তা পাঠাবে।
লোকসভায় ঘটনার পর থেকে সমগ্র দেশের রাজনৈতিক মহলে এই নিয়ে তীব্র আলোচনা শুরু হয়েছে। কেউ এটিকে “রাজনৈতিক শুদ্ধতার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ” বলে সমর্থন করছেন, আবার কেউ “গণতন্ত্র ধ্বংসের ষড়যন্ত্র” বলে কড়া সমালোচনা করছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যদি বিলটি সংসদের উভয় কক্ষেই পাস হয়, তবে এটি ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে এক বড় মোড় ঘোরানো মুহূর্ত হয়ে দাঁড়াবে।
লোকসভায় বুধবারের ঘটনায় স্পষ্ট, এই বিল নিয়ে রাজনৈতিক লড়াই আগামী দিনে আরও তীব্র হতে চলেছে। একদিকে সরকার দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের স্বপ্ন দেখাচ্ছে, অন্যদিকে বিরোধীরা জনগণের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রকে বাঁচানোর লড়াইয়ের ডাক দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সংসদের ভোটাভুটিতে কী সিদ্ধান্ত হয়, সেদিকেই তাকিয়ে দেশবাসী।