বিহার পুলিশের আর্থিক অপরাধ ইউনিট (Bihar Police) একটি বড় সাফল্য অর্জন করেছে। আন্তর্জাতিক সাইবার জালিয়াতি চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে। এই চক্রটি সিম বক্সের মাধ্যমে একটি সমান্তরাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ পরিচালনা করছিল, যা কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড এবং অন্যান্য দেশে অবস্থিত সাইবার জালিয়াতির কেন্দ্রগুলির সঙ্গে যুক্ত ছিল।
গ্রেফতার হওয়া অভিযুক্তদের মধ্যে মূল মাস্টারমাইন্ড হর্ষিত কুমারও রয়েছেন। এই অভিযানে পুলিশ ১২টি মোবাইল ফোন, একাধিক প্রি-অ্যাক্টিভেটেড সিম কার্ড, এটিএম কার্ড, পাসবুক এবং জাল নথি উদ্ধার করেছে। এই ঘটনা বিহার পুলিশের সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানকে আরও জোরদার করেছে।
অপরাধ চক্রের কার্যপ্রণালী
এই সাইবার অপরাধীরা জামতাড়া ও দেওঘরের বাসিন্দা হলেও মাধবানী, বিহারে ভাড়া বাড়িতে থেকে তাঁদের অপরাধমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। তাঁরা বিশেষভাবে ডিজাইন করা ম্যালিশিয়াস অ্যাপ্লিকেশন (APK ফাইল) হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ইন্দ্রপ্রস্থ গ্যাস, গ্রিন গ্যাস এবং বিদ্যুৎ সংযোগধারীদের মোবাইল নম্বরে পাঠাত।
এই APK ফাইলগুলির মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে তারা অনলাইন ব্যাঙ্কিং এবং পেমেন্ট ওয়ালেট ব্যবহার করে শিকারের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরিয়ে নিত। জালিয়াতির মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ বিহার, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ এবং সিকিমের বিভিন্ন এটিএম থেকে তুলে নেওয়া হতো।
এছাড়া, এই টাকা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ এবং পেট্রোল পাম্পে ব্যবহার করা হতো, যা পরে নগদে ভাগ করে নেওয়া হতো।এই চক্রটি তাদের অবস্থান গোপন রাখতে ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করত। তারা দারভাঙ্গা, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং এবং গ্যাংটকে হোটেলে থেকে এবং বিভিন্ন মোবাইল ডিভাইড এবং জাল আইডি দিয়ে সিম কার্ড ব্যবহার করে তাদের অপরাধমূলক কার্যক্রম চালাত।
জাতীয় সাইবার ক্রাইম রিপোর্টিং পোর্টাল (NCRP) থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এই অপরাধীরা উত্তর প্রদেশের লখনউ, আগ্রা এবং কানপুর-সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক সাইবার জালিয়াতির ঘটনায় জড়িত ছিল।
অভিযানের বিশদ বিবরণ
বিহার পুলিশের আর্থিক অপরাধ ইউনিট এই অভিযানের জন্য একটি বিশেষ দল গঠন করেছিল, যারা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করে। অভিযুক্তদের মধ্যে হর্ষিত কুমারকে এই চক্রের মূল মাস্টারমাইন্ড হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পুলিশ এই অভিযানে ১২টি মোবাইল ফোন, একাধিক সিম কার্ড, এটিএম কার্ড, পাসবুক, চেকবই এবং জাল আধার কার্ড উদ্ধার করেছে।
এই নথিগুলি তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র সরবরাহ করছে। ইওইউ-এর একজন সিনিয়র অফিসার জানিয়েছেন, “এই চক্রটি অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে কাজ করছিল। তারা সিম বক্স ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক কলগুলিকে স্থানীয় কল হিসেবে দেখিয়ে জালিয়াতি করত, যা সাইবার অপরাধের একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।”
এই অপরাধীদের কার্যক্রম শুধু ভারতে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটি কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড এবং অন্যান্য দেশে অবস্থিত সাইবার জালিয়াতি কেন্দ্রের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। এই চক্রটি আন্তর্জাতিক স্তরে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কৌশল ব্যবহার করে শিকারদের প্রতারিত করত, যেমন জাল ওয়েবসাইট, টেলিগ্রাম গ্রুপ এবং ফেক কল সেন্টারের মাধ্যমে। এই অভিযানে বিহার পুলিশ অন্যান্য রাজ্যের সাইবার ক্রাইম ইউনিটগুলির সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করেছে এবং ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ এবং সিকিমে অতিরিক্ত সদস্যদের গ্রেপ্তারের জন্য দল পাঠিয়েছে।
আন্তর্জাতিক সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে বৃহত্তর অভিযান
এই গ্রেফতার বিহার পুলিশের সাম্প্রতিক সাইবার অপরাধ বিরোধী অভিযানের একটি অংশ। কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো (সিবিআই) এবং ইন্টারপোলের সঙ্গে সমন্বয়ে ভারতীয় পুলিশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাইবার অপরাধ চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে।
সিবিআই-এর ‘অপারেশন চক্র-৫’ এর অধীনে সম্প্রতি ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যারা ৮.৫ লক্ষ মিউল অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সাইবার জালিয়াতি চালাচ্ছিল। এই অভিযানে বিহার, উত্তর প্রদেশ, দিল্লি, হরিয়ানা এবং মহারাষ্ট্রে অভিযান চালানো হয়েছে। বিহারের এই সাম্প্রতিক গ্রেফতার সেই অভিযানেরই একটি অংশ, যা আন্তর্জাতিক সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে ভারতের দৃঢ় অবস্থানকে তুলে ধরে।
সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব
এই গ্রেপ্তার রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। বিরোধী দলের নেতারা সরকারের উপর তদন্তের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এই ঘটনা কেন্দ্রীয় সরকারের তদন্তকারী সংস্থাগুলির দায়বদ্ধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে, মুম্বাই ট্রেন বিস্ফোরণ মামলায় অভিযুক্তদের খালাসের ঘটনা তদন্তের ত্রুটির বিষয়টিকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
‘শহিদ দিবসে’ ল্যাংচা কামড়ে নিশ্চিন্ত তৃণমূল সমর্থকরা সরকার গড়ার স্বপ্নে বিভোর
জনগণের জন্য সতর্কতা
বিহার পুলিশ জনগণকে সাইবার জালিয়াতির বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে। তারা বলেছে, অজানা লিঙ্কে ক্লিক করা, ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করা এবং অপরিচিত অ্যাপ ইনস্টল করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সাইবার ক্রাইম রিপোর্টিং পোর্টাল (১৯৩০) বা স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে যেকোনো সন্দেহজনক কার্যকলাপের বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বিহার পুলিশের এই অভিযান সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আন্তর্জাতিক সাইবার অপরাধ চক্রের সঙ্গে যুক্ত এই গ্যাংয়ের পতন ভারতের সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে।
তবে, এই ধরনের অপরাধের ক্রমবর্ধমান প্রকৃতি এবং আন্তর্জাতিক সংযোগের কারণে সিবিআই, ইন্টারপোল এবং স্থানীয় পুলিশের মধ্যে আরও শক্তিশালী সমন্বয়ের প্রয়োজন। এই ঘটনা জনগণের মধ্যে সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতা বাড়ানোর গুরুত্বও তুলে ধরেছে।