ভারতের প্রাচীন সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক ঐতিহ্যের দুটি অমর কীর্তি, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (Bhagavad Gita ) এবং ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্র (Natyashastra), ইউনেস্কোর (UNESCO)মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে স্থান পেয়েছে। এই বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি ভারতের চিরন্তন জ্ঞান এবং শৈল্পিক প্রতিভার প্রতি সম্মান প্রকাশ করে। এই দুটি গ্রন্থ কেবল সাহিত্যিক সম্পদ নয়, বরং ভারতের দার্শনিক ও নান্দনিক ভিত্তি, যা ভারতীয় বিশ্বদৃষ্টি, চিন্তাধারা, জীবনযাপন এবং প্রকাশের ধরনকে গঠন করেছে। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে ভারতের মোট ১৪টি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এই আন্তর্জাতিক রেজিস্টারে স্থান পেল।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার (Bhagavad Gita) তাৎপর্য
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, মহাভারতের ভীষ্মপর্বের একটি অংশ, বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এবং পবিত্র দার্শনিক গ্রন্থ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের কাছে যুদ্ধক্ষেত্রে এই উপদেশ প্রদান করেছিলেন, যা কর্ম, ধর্ম, ভক্তি এবং জ্ঞানের পথের এক অপূর্ব সমন্বয়। গীতার ৭০০ শ্লোক বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনদর্শনকে প্রভাবিত করেছে। এটি কেবল হিন্দু দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু নয়, বরং মানবজাতির জন্য নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনার একটি সর্বজনীন গ্রন্থ। গীতার বাণী আজও জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং আত্ম-উপলব্ধির পথে প্রাসঙ্গিক।
ইউনেস্কোর মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে গীতার অন্তর্ভুক্তি ভারতের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ। এটি ভারতীয় দর্শনের গভীরতা এবং এর সর্বজনীন আবেদনকে তুলে ধরে। গীতার বাণী বিশ্ব শান্তি, সহনশীলতা এবং মানবতার মূল্যবোধ প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্র
ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্র ভারতীয় নাট্যকলা, সঙ্গীত, নৃত্য এবং অভিনয়ের প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে বিস্তৃত গ্রন্থ। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যে রচিত এই গ্রন্থটি ভারতীয় শিল্প ও সংস্কৃতির ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। নাট্যশাস্ত্রের ৩৬টি অধ্যায়ে নাটকের রচনা, অভিনয়ের কৌশল, রস সিদ্ধান্ত, সঙ্গীত, নৃত্য, মঞ্চ নির্মাণ এবং দর্শকদের মানসিক প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। এটি ভারতীয় নান্দনিকতার একটি মূল গ্রন্থ, যা “রস” তত্ত্বের মাধ্যমে শিল্পের মাধ্যমে আবেগ প্রকাশের বিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করে।
নাট্যশাস্ত্র কেবল ভারতীয় শিল্পকলাকেই প্রভাবিত করেনি, বরং বিশ্বব্যাপী থিয়েটার এবং পারফর্মিং আর্টের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। এটি ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য যেমন ভরতনাট্যম, কত্থক এবং ওড়িশি এবং থিয়েটারের বিভিন্ন রূপের ভিত্তি স্থাপন করেছে। ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্রের শৈল্পিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বকে বিশ্ব মঞ্চে তুলে ধরেছে।
ইউনেস্কোর মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার
ইউনেস্কোর মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড প্রোগ্রাম বিশ্বের তথ্যচিত্র ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং প্রচারের জন্য ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই রেজিস্টারে এমন দলিল, পাণ্ডুলিপি এবং গ্রন্থ অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা বিশ্ব সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের জন্য অপরিহার্য। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা এবং নাট্যশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্তি ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গভীরতা এবং বৈচিত্র্যকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছে।
ভারতের অন্যান্য ১২টি ঐতিহ্য যা এই রেজিস্টারে রয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে ঋগ্বেদের পাণ্ডুলিপি, রামচরিতমানস, তামিল চিকিৎসা পাণ্ডুলিপি এবং সাহিত্য সম্মেলনের আর্কাইভ। এই ১৪টি স্বীকৃতি ভারতের জ্ঞান, শিল্প এবং সংস্কৃতির বিশ্বব্যাপী প্রভাবের প্রমাণ।
ভারতের প্রতিক্রিয়া
ভারত সরকার এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলি এই স্বীকৃতিকে উৎসবের মতো উদযাপন করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানিয়েছেন, “শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা এবং নাট্যশাস্ত্রের ইউনেস্কোর মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্তি ভারতের প্রাচীন জ্ঞান এবং শৈল্পিক ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বের শ্রদ্ধার প্রতিফলন। এটি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ ও প্রচারে আমাদের প্রতিশ্রুতিকে আরও শক্তিশালী করবে।” সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ও এই অর্জনকে ভারতের নরম শক্তির বিজয় হিসেবে উল্লেখ করেছে।
ভবিষ্যৎ প্রভাব
ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা এবং নাট্যশাস্ত্রের বিশ্বব্যাপী গবেষণা, অনুবাদ এবং শিক্ষার প্রচারে নতুন গতি সঞ্চার করবে। এটি ভারতীয় সংস্কৃতি ও দর্শনের প্রতি তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ বাড়াবে এবং বিশ্বব্যাপী শান্তি, সহনশীলতা এবং শৈল্পিক উৎকর্ষের বার্তা ছড়িয়ে দেবে। এই গ্রন্থগুলি ভারতের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং বিশ্ব সংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা এবং ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্রের ইউনেস্কোর মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্তি ভারতের জন্য একটি গর্বের মুহূর্ত। এই দুটি গ্রন্থ ভারতীয় জ্ঞান, দর্শন এবং শিল্পের চিরন্তন উৎস, যা বিশ্ব মঞ্চে ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদাকে আরও উজ্জ্বল করেছে। ভারতের ১৪টি ঐতিহ্য এই রেজিস্টারে স্থান পাওয়ার মাধ্যমে দেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ইতিহাস বিশ্বের কাছে আরও প্রকাশিত হয়েছে। এই স্বীকৃতি ভারতীয়দের জন্য তাদের ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও প্রচারের দায়িত্ব পুনর্বিবেচনার একটি সুযোগ।