বেঙ্গালুরু, ২২ সেপ্টেম্বর: ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও সামাজিক রক্ষণশীলতার চরম নজির স্থাপন করল বেঙ্গালুরুর কনকপুরা তালুকের ইন্দিরানগর এলাকা। প্রেমিকার সঙ্গে “লিভ-ইন” সম্পর্কে থাকার অপরাধে এক যুবককে (মহেশ) নির্মমভাবে হেনস্তা করা হয়েছে, শুধু তাই নয়, তাঁর ও তাঁর মুসলিম প্রেমিকা আসিনের মাথার অর্ধেক চুল কেটে টনসূর করে দেওয়া হয়েছে—যা একটি মধ্যযুগীয় শাস্তির মতোই বর্বর ও অপমানজনক। ঘটনাটি ধর্মীয় মৌলবাদ ও তথাকথিত পারিবারিক সম্মানের নামে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হরণ করার একটি উদ্বেগজনক উদাহরণ হয়ে উঠেছে।
ঘটনার বিবরণ
আসিন নামের এক মুসলিম তরুণী, যিনি ছয় মাস আগে তাঁর বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে আলাদা হয়ে যান, বর্তমানে মহেশ নামের এক হিন্দু যুবকের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে ছিলেন এবং তাঁরা একসাথে “লিভ-ইন” অবস্থায় ছিলেন। শনিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে, তাঁরা মহেশের বন্ধুর বাড়িতে সময় কাটাচ্ছিলেন।
এই সময়েই আসিনের আত্মীয়স্বজন তাঁদের খুঁজে পেয়ে ঘরে ঢুকে জোরপূর্বক নিয়ে যায় এবং শুরু হয় নির্মম অত্যাচার। মহেশ ও আসিনকে বেধড়ক মারধর করা হয়, এরপর দুজনের মাথার অর্ধেক চুল কেটে টনসূর করে দেওয়া হয়। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল সমাজের সামনে অপমান করা এবং সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য করা।
পুলিশ জানিয়েছে, এই হামলার ঘটনায় মোট সাতজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচজনকে ইতোমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে, বাকিদের খোঁজে তল্লাশি চলছে। অভিযুক্তদের মধ্যে এক নারীও রয়েছেন বলে জানা গেছে।
আইনি ব্যবস্থা ও প্রতিক্রিয়া
পুলিশ দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করলেও, এই ঘটনা সমাজে যে আতঙ্ক তৈরি করেছে, তা এখনও কাটেনি। ভুক্তভোগী দম্পতির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, ধর্ম ও লিঙ্গের ভিত্তিতে তাঁদের এই নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অপহরণ, শারীরিক নির্যাতন, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা লঙ্ঘন ও মানসিক হেনস্তার ধারায় মামলা হয়েছে।
সামাজিক বাস্তবতা ও নৈতিক প্রশ্ন
এই ঘটনা আবারও দেখিয়ে দিল, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং পারিবারিক সম্মানের নামে ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে। ভারতে সংবিধান প্রত্যেক নাগরিককে ধর্ম, জাত, লিঙ্গ নির্বিশেষে সমান অধিকার দিয়েছে—তবে বাস্তবে তা কার্যকর হতে গেলে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি।
এই ঘটনাকে ‘নৈতিক পুলিশিং’-এর একটি চরম রূপ বলেই মনে করছেন মানবাধিকার কর্মীরা। একটি প্রাপ্তবয়স্ক নারী তার জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা রাখে—সে যেই ধর্মেরই হোক না কেন। মহেশ এবং আসিনের অপরাধ একটাই—তাঁরা সমাজের তথাকথিত নিয়ম ভেঙে ভালোবাসা বেছে নিয়েছেন।
মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিক্রিয়া ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই ঘটনার কড়া সমালোচনা করেছে। তাঁরা বলছে, এই ধরনের ঘটনার দ্রুত বিচার না হলে সমাজে একটি ভুল বার্তা যাবে—যেখানে ধর্মীয় ও পারিবারিক চাপকে আইনের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হবে।
রাজ্য প্রশাসন থেকেও জানানো হয়েছে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং লিভ-ইন বা আন্তঃধর্ম সম্পর্কের অধিকারকে সম্মান জানিয়ে সমাজে সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে।
মিডিয়ার ভূমিকা ও সামাজিক আলোড়ন
এই ঘটনার ভিডিও এবং বিবরণ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, আবার কেউ কেউ মৌন সমর্থন দিচ্ছেন—এতে সমাজের বিভাজনও ফুটে উঠছে।
এই ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ভালোবাসার অধিকার এখনও সমাজের এক শ্রেণির মানুষের চোখে “শাস্তিযোগ্য অপরাধ”। ধর্মীয় পরিচয়, সামাজিক শ্রেণি বা পারিবারিক সম্মানের নামে কোনো ব্যক্তি বা দম্পতির উপর এমন বর্বর আচরণ কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।
রাষ্ট্র, প্রশাসন ও সমাজ—তিনটি স্তরেই এখন প্রয়োজন কঠোর অবস্থান নেওয়ার। না হলে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আর মানবাধিকার কেবল সংবিধানে লেখা থাকবে, বাস্তবে তার অস্তিত্ব থাকবে না।

আমাদের Google News এ ফলো করুন
২৪ ঘণ্টার বাংলা নিউজ, ব্রেকিং আপডেট আর এক্সক্লুসিভ স্টোরি সবার আগে পেতে ফলো করুন।
