নয়াদিল্লি: বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল। ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রীয় বর্বরতার অভিযোগে সোমবার এই ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেন বিচারপতি গোলাম মোর্তুজা মজুমদার। রায়ের সময় আদালত জানায়—হাসিনা তিনটি গুরুতর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন: হিংসা উসকে দেওয়া, হত্যার নির্দেশ দেওয়া এবং নৃশংসতার সময় কোনও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ না নেওয়া।
রায়ের আগে পর্যন্ত তাঁকে আজীবন কারাদণ্ড দেওয়ার সুপারিশ করা হচ্ছিল। কিন্তু অতিরিক্ত অভিযোগ যুক্ত হওয়ার পর ট্রাইবুনাল জানায়, “আমরা একটিই শাস্তি দিচ্ছি, মৃত্যুদণ্ড।” একই মামলায় বাংলাদেশের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন তদন্তে সহযোগিতা করায় ও অপরাধ স্বীকার করায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন।
কোন কোন অভিযোগে সাজা পেলেন হাসিনা?
ট্রাইবুনালের অভিযোগপত্র অনুযায়ী পাঁচটি অপরাধেই অভিযুক্ত ছিলেন হাসিনা ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা—
- ঢাকায় ছাত্র আন্দোলনকারীদের ওপর গণহত্যা সংগঠনের অভিযোগ
- বিক্ষোভকারীদের ওপর হেলিকপ্টার ও ড্রোন থেকে গুলি চালানো
- ছাত্রনেতা আবু সায়েদের হত্যার নির্দেশ
- প্রমাণ নষ্টের জন্য আশুলিয়ায় লাশ পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা
- চাঁখারপুলে সমন্বিতভাবে আন্দোলনকারীদের হত্যাকাণ্ড
ট্রাইবুনাল বলেছে—রাষ্ট্রীয় শক্তিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে সাধারণ ছাত্র ও নাগরিকদের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল।
হাসিনার প্রতিক্রিয়া: ‘এটা সাজানো মামলা’ Bangladesh Seeks Hasina Extradition
রায় ঘোষণার পর ভারতবর্ষে নির্বাসনে থাকা শেখ হাসিনা একে ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’, ‘নকল বিচার’ এবং ‘কারচুপির রায়’ বলে মন্তব্য করেন। তাঁর দাবি—ইউনূস-নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার তাঁকে রাজনৈতিকভাবে নিশ্চিহ্ন করতে চাইছে।
অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের রায়কে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বিবৃতিতে বলা হয়েছে—
“বাংলাদেশের আদালত অত্যন্ত স্পষ্ট ও ন্যায়সঙ্গত বার্তা দিয়েছে—ক্ষমতা যতই বড় হোক, আইন সবার উপরে।”
ভারতে প্রত্যর্পণ চাইল ঢাকা
রায় ঘোষণার পর বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতকে অনুরোধ জানিয়েছে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে ঢাকায় ফিরিয়ে দেওয়ার। উভয়েই গত অগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সময় বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন এবং অনুপস্থিতিতেই তাঁদের বিচার প্রক্রিয়া চলে।
বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে—দুই দেশের প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী ভারত বাধ্যতামূলকভাবে তাঁদের ফিরিয়ে দিতে বাধ্য।
ভারত অবশ্য আরও সতর্ক। নয়াদিল্লি জানিয়েছে, “ভারত বাংলাদেশের জনগণের শান্তি, গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা রায়টি খতিয়ে দেখছি।”
এরপর কী? হাসিনার ভবিষ্যৎ কোন পথে
শেখ হাসিনার ভাগ্য এখন অনেকটাই নির্ভর করছে ভারতের অবস্থান ও পরবর্তী কূটনৈতিক আলোচনার ওপর।
রায়ের পর যা হতে পারে—
- বাংলাদেশ প্রথমে হাসিনার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করবে
- রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ আছে, তবে শর্ত একটাই—হাসিনাকে আগামী ৩০ দিনের মধ্যে দেশে ফিরতে হবে
- তিনি যদি দেশে না ফেরেন, তবে তাঁকে ‘পলাতক’ ঘোষণা করা হবে
- এরপর তাঁর পাসপোর্ট বাতিল, সম্পত্তি জব্দ এবং ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করতে পারবে বাংলাদেশ সরকার
সামনে কী ঝড়?
রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা-নয়াদিল্লি কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুন ও জটিল এক অধ্যায়ে ঢুকে পড়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে সুনামি তৈরি হয়েছে, তার অভিঘাত এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পৌঁছেছে।
আপাতত বিশ্বের দৃষ্টি ভারতের দিকে—নয়াদিল্লি কি ঢাকার প্রত্যর্পণ আবেদনে সাড়া দেবে, না কি নতুন কোনও মানবাধিকার বিতর্কের জন্ম হবে—এই প্রশ্নেই অনিশ্চয়তার ভারে ঝুলে রয়েছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী প্রাক্তন শাসক শেখ হাসিনা।
