Ganga Water Treaty: গঙ্গা জল চুক্তি পুনর্নবীকরণের আলোচনায় ভারতে আসছে বাংলাদেশি প্রতিনিধি দল

গঙ্গা জল চুক্তি (Ganga Water Treaty) পুনর্নবীকরণ নিয়ে আলোচনার জন্য একটি ১১ সদস্যের বাংলাদেশী প্রতিনিধি দল আগামী সোমবার (৩ মার্চ) ভারতে আসছে। ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত…

Bangladesh Delegation to Visit India for Ganga Water Treaty Renewal Talks

গঙ্গা জল চুক্তি (Ganga Water Treaty) পুনর্নবীকরণ নিয়ে আলোচনার জন্য একটি ১১ সদস্যের বাংলাদেশী প্রতিনিধি দল আগামী সোমবার (৩ মার্চ) ভারতে আসছে। ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত এই চুক্তি, যা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সীমান্ত-স্পর্শী গঙ্গা নদীর জল ভাগাভাগির জন্য ৩০ বছরের একটি ব্যবস্থা তৈরি করেছিল, ২০২৬ সালে মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। আগামী সপ্তাহে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ কারিগরি বিশেষজ্ঞ কমিটির ৮৬তম বৈঠকে এই চুক্তির পুনর্নবীকরণ নিয়ে আলোচনা হবে।

বাংলাদেশের ‘দ্য ডেইলি স্টার’ পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিনিধি দলটির নেতৃত্ব দেবেন যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) সদস্য মুহাম্মদ আবুল হোসেন। দলটি ৩ মার্চ কলকাতায় পৌঁছাবে এবং সঙ্গে সঙ্গে ফারাক্কায় গঙ্গা নদীর যৌথ পর্যবেক্ষণ স্থলে দুই দিনের সফরে যাবে। এই সফর ৫ মার্চ সকাল পর্যন্ত চলবে। এরপর তারা কলকাতায় ফিরে ৬ ও ৭ মার্চ ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের অধীনে দুই দিনের বৈঠকে অংশ নেবে। এই তথ্য জলশক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র জয়েন্ট কমিশনার (এফএম) আর আর সম্ভরিয়ার একটি চিঠি থেকে জানা গেছে।

kolkata24x7-sports-News

   

মুহাম্মদ আবুল হোসেন পত্রিকাটিকে বলেন, “যৌথ নদী কমিশন বছরে একবার বৈঠক করে সীমান্ত-স্পর্শী নদী নিয়ে আলোচনা করে।” তিনি জানান, এই বৈঠকে গঙ্গা নদীর জল ভাগাভাগি এবং চুক্তির পুনর্নবীকরণ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে। ভারতের জলশক্তি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ভারত ও বাংলাদেশ ৫৪টি নদী ভাগ করে নেয়। ১৯৭২ সালে গঠিত যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) দুই দেশের মধ্যে সাধারণ, সীমান্ত ও সীমান্ত-স্পর্শী নদী সংক্রান্ত পারস্পরিক স্বার্থের বিষয়গুলো সমাধানের জন্য একটি দ্বিপাক্ষিক ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে।

গঙ্গা জল চুক্তির ইতিহাস
গঙ্গা জল চুক্তি ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবে গৌড়া এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এই চুক্তি গঙ্গা নদীর জল ভাগাভাগির জন্য একটি কাঠামো তৈরি করে, যা ফারাক্কা বাঁধ থেকে শুষ্ক মৌসুমে (জানুয়ারি থেকে মে) জলের প্রবাহ নিশ্চিত করে। চুক্তিটি ৩০ বছরের জন্য কার্যকর ছিল এবং ২০২৬ সালের ১২ ডিসেম্বর এর মেয়াদ শেষ হবে।

শেখ হাসিনার শেষ ভারত সফরে—২০২৪ সালের জুন মাসে, যিনি আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে এসেছিলেন—দুই দেশ ১৯৯৬ সালের চুক্তি পুনর্নবীকরণের জন্য কারিগরি আলোচনা শুরুর ঘোষণা দেয়। এই সফরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকের পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে, হাসিনার সরকার পতনের পর বাংলাদেশের নতুন নেতৃত্বের সঙ্গে এই আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব এখন বর্তমান প্রশাসনের ওপর।

চুক্তির গুরুত্ব ও প্রেক্ষাপট
গঙ্গা নদী ভারত ও বাংলাদেশের জন্য একটি জীবনরেখা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কা বাঁধে গঙ্গার জল ভাগ করা হয়, যা ভারতের হুগলি নদী এবং বাংলাদেশের পদ্মা নদীতে প্রবাহিত হয়। বাংলাদেশের কৃষি, মৎস্য ও জীবিকার জন্য এই জল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চুক্তি অনুযায়ী, শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কায় জলের প্রবাহ ৭০,০০০ কিউসেকের কম হলে দুই দেশ সমান ভাগে (৩৫,০০০ কিউসেক) পায়। ৭০,০০০ থেকে ৭৫,০০০ কিউসেকের মধ্যে থাকলে বাংলাদেশ ৩৫,০০০ কিউসেক পায় এবং ভারত বাকিটা। ৭৫,০০০ কিউসেকের বেশি হলে ভারত ৪০,০০০ কিউসেক নেয় এবং বাংলাদেশ বাকিটা পায়।

তবে, বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে, শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত জল না পাওয়ায় তাদের কৃষি ও জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ এবং উজানে ভারতের জল ব্যবহার এই সমস্যাকে আরও জটিল করেছে। ভারতের পক্ষে ফারাক্কা থেকে জল হুগলি নদীতে প্রবাহিত করে কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। এই দ্বৈত প্রয়োজনীয়তা দুই দেশের মধ্যে আলোচনাকে জটিল করে তুলেছে।

আসন্ন আলোচনার তাৎপর্য
পুনর্নবীকরণ নিয়ে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ কারণ গঙ্গার জল দুই দেশের জন্যই অপরিহার্য। বাংলাদেশের জন্য এই চুক্তি তাদের পানির চাহিদা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং শুষ্ক মৌসুমে নিশ্চিত প্রবাহ নিশ্চিত করার একটি সুযোগ। ভারতের জন্য, এটি একটি ভারসাম্য বজায় রাখার চ্যালেঞ্জ—যাতে বাংলাদেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি নিজেদের প্রয়োজনও পূরণ হয়।

ফারাক্কায় যৌথ পর্যবেক্ষণ স্থল পরিদর্শন এই আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই স্থানে দুই দেশের প্রতিনিধিরা গঙ্গার প্রবাহ পরিমাপ করে এবং তথ্য সংগ্রহ করে। বাংলাদেশী প্রতিনিধি দলের এই সফর বৈঠকের জন্য তথ্যভিত্তিক ভিত্তি তৈরি করবে। ৬-৭ মার্চের বৈঠকে এই তথ্যগুলো আলোচনার ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।

রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট
শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়েছে। নতুন সরকারের অধীনে এই আলোচনা একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসতে পারে। ভারতের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী মোদি এই চুক্তির পুনর্নবীকরণকে গুরুত্ব দিয়েছেন, যা দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার একটি অংশ। তবে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই আলোচনায় তাদের সম্পৃক্ততার অভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত বছর জানিয়েছিলেন, ফারাক্কা চুক্তির প্রভাব রাজ্যের জনগণের জীবিকার ওপর পড়ে, তাই তাদের মতামত গ্রহণ করা উচিত।

চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
পুনর্নবীকরণ আলোচনায় বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গঙ্গার প্রবাহে অনিশ্চয়তা বেড়েছে। বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত জলের দাবি জানাতে পারে, যেখানে ভারত হুগলি নদী ও কলকাতা বন্দরের জন্য জলের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরবে। এছাড়া, দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশগত প্রবাহ নিশ্চিত করাও আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে।

তবে, এই আলোচনা দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার একটি নতুন দিগন্ত খুলতে পারে। যৌথ নদী কমিশনের মাধ্যমে নিয়মিত তথ্য বিনিময় এবং পর্যবেক্ষণ এই প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করবে। দুই দেশের জন্যই গঙ্গা নদী একটি জীবনরেখা, এবং এর টেকসই ব্যবস্থাপনা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অপরিহার্য।

বাংলাদেশী প্রতিনিধি দলের এই সফর গঙ্গা জল চুক্তির পুনর্নবীকরণের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। ফারাক্কা পরিদর্শন এবং কলকাতায় বৈঠকের ফলাফল আগামী বছরের আলোচনার দিক নির্দেশ করবে। দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং বিশ্বাসের ভিত্তিতে এই চুক্তি পুনর্নবীকরণ হলে, গঙ্গা নদী উভয় দেশের জনগণের জন্য একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে।