পহেলগাঁওয়ের (pahalgam) সাম্প্রতিক নৃশংস হত্যালীলার প্রতিবাদ করে এবার সরব বাংলাপক্ষ। সমাজ মাধ্যমের একই পোস্টে বাংলা পক্ষ দাবি করেছে পুলওয়ামা বা পহেলগাঁও নয় এবার বদলা চাই। পাক অধিকৃত কাশ্মীর দখলের দাবি করেছে বাংলা পক্ষ। সমাজ মাধ্যমের এই পোস্ট ঘিরে উঠে এসেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
তবে এই ধরণের পোস্ট দেখে তা আবেগ তাড়িত পোস্ট বলেই মনে হয়, তার কারণ পাক অধিকৃত কাশ্মীর দখল করতে হলে এর মধ্যে যে রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে এবং ভবিষৎ পরিস্থিতির উপর নজর রাখতে হয়। সমাজ মাধ্যম এই মুহূর্তে মানুষের কাছে খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাওয়ার একটি পথ হলেও, এইধরণের সমস্যা সম্বদ্ধে কিছু বলতে হলে তা এর ঐতিহাসিক এবং কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করেই করা উচিৎ।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং বিভাজন (pahalgam)
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের পর কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং ভারতের সঙ্গে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন। এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান-সমর্থিত উপজাতীয় মিলিশিয়া কাশ্মীর আক্রমণ করে। ১৯৪৮ সালে যুদ্ধবিরতির পর কাশ্মীরের একটি অংশ পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, যা বর্তমানে পাক অধিকৃত কাশ্মীর নামে পরিচিত (আজাদ কাশ্মীর এবং গিলগিট-বাল্টিস্তান)। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় নিয়ন্ত্রণ রেখা (LoC) প্রতিষ্ঠিত হয়, যা দুই দেশের মধ্যে সীমানা হিসেবে কাজ করে।
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের প্রস্তাবে কাশ্মীরে গণভোটের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তবে পাকিস্তানের সেনা প্রত্যাহার এবং অন্যান্য শর্ত পূরণ না হওয়ায় তা কার্যকর হয়নি। এই ঐতিহাসিক ব্যর্থতা পাক অধিকৃত কাশ্মীরের স্থিতাবস্থাকে আরও জটিল করে তুলেছে।
পাক অধিকৃত কাশ্মীরে পাকিস্তান সরকার আজাদ কাশ্মীরে একটি আধা-স্বায়ত্তশাসিত সরকার এবং গিলগিট-বাল্টিস্তানে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। এই অঞ্চলগুলো পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি এবং মুদ্রানীতির অধীনে রয়েছে, যা এর উপর পাকিস্তানের দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ নির্দেশ করে।
বীমা দাবিতে বিরোধ? জানুন আপনার আপিলের অধিকার
সামরিক ও ভূ-কৌশলগত জটিলতা
LoC পৃথিবীর সবচেয়ে সামরিকীকৃত সীমান্তগুলোর একটি। ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই এখানে বিপুল সংখ্যক সেনা মোতায়েন করেছে। পাক অধিকৃত কাশ্মীরের পুনর্দখলের জন্য সরাসরি সামরিক অভিযানের অর্থ হবে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ, যা উভয় দেশের পারমাণবিক শক্তির কারণে বিপর্যয়কর হতে পারে। পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ভূখণ্ড, বিশেষ করে গিলগিট-বাল্টিস্তান, পাহাড়ি এবং দুর্গম। এই অঞ্চলে সামরিক অভিযান পরিচালনা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং এবং সম্পদ-নিবিড় হবে।
পাক অধিকৃত কাশ্মীরের গিলগিট-বাল্টিস্তানের মধ্য দিয়ে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (CPEC) গেছে, যা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বার্থ পাক অধিকৃত কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ পরিবর্তনের প্রচেষ্টাকে আরও জটিল করে তুলতে পারে । ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান শাকসগাম উপত্যকা চীনের কাছে হস্তান্তর করে, যা ভারতের দাবিকৃত অঞ্চল। এটি পাক অধিকৃত কাশ্মীরের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বাড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক বাধা
কাশ্মীর ইস্যু ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়, যেমনটি ১৯৭২ সালের শিমলা চুক্তিতে উল্লেখ আছে। পাক অধিকৃত কাশ্মীর পুনর্দখলের জন্য একতরফা সামরিক পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে এবং ভারতের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা বা কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র কাশ্মীরে যেকোনো সামরিক সংঘাতকে বিপজ্জনক করে তোলে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন, এই অঞ্চলে যুদ্ধ এড়াতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। PoK-এর জনগণের একটি অংশ পাকিস্তানের শাসনের প্রতি অসন্তুষ্ট হলেও, তাদের মধ্যে ভারতের প্রতি সর্বজনীন সমর্থন নেই। কোনো সামরিক পদক্ষেপ স্থানীয় প্রতিরোধের মুখে পড়তে পারে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করবে।
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা
পাক অধিকৃত কাশ্মীর পুনর্দখলের জন্য সামরিক অভিযান এবং পরবর্তী শাসন ব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ভারতের অর্থনীতি এই ধরনের দীর্ঘমেয়াদী সংঘাতের জন্য প্রস্তুত নাও হতে পারে, বিশেষ করে যখন দেশটি উন্নয়ন ও অবকাঠামোর ওপর জোর দিচ্ছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং জনমত এই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে যেতে পারে। ২০১৯ সালে ধারা ৩৭০ বাতিলের পর কাশ্মীরে ভারতের নীতি আন্তর্জাতিকভাবে পর্যবেক্ষিত হচ্ছে, এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরের দিকে আগ্রাসী পদক্ষেপ আরও সমালোচনার জন্ম দিতে পারে।
বিকল্প পন্থা ও বর্তমান নীতি
ভারতের বর্তমান নীতি পাক অধিকৃত কাশ্মীরকে (pahalgam) তার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দাবি করলেও, এটি কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপের মাধ্যমে পাকিস্তানের ওপর প্রভাব বিস্তারের দিকে মনোনিবেশ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলার পর ভারতের বালাকোট এয়ারস্ট্রাইক ছিল সীমিত ও লক্ষ্যভিত্তিক পদক্ষেপ, যা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ এড়িয়ে চলে।
পাক অধিকৃত কাশ্মীরের জনগণের মধ্যে অসন্তোষ (যেমন, পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা বা রাজনৈতিক অধিকারের অভাব) কাজে লাগিয়ে ভারত কূটনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করতে পারে, তবে সরাসরি পুনর্দখলের সম্ভাবনা কম।
পাক-অধিকৃত কাশ্মীর (pahalgam) পুনর্দখল ঐতিহাসিকভাবে সৃষ্ট স্থিতাবস্থা, সামরিক জটিলতা, আন্তর্জাতিক কূটনীতি, চীনের ভূমিকা এবং পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকির কারণে সম্ভব নয়। ১৯৪৭ সাল থেকে এই অঞ্চলের বিভাজন এবং পরবর্তী ঘটনাবলি একটি স্থায়ী সীমানা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা তৈরি করেছে, যা একতরফাভাবে পরিবর্তন করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ভারতের জন্য কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক কৌশলই এই মুহূর্তে বাস্তবসম্মত পন্থা বলে বিবেচিত হয়।
ভারত সরকার ইতিমধ্যেই সেই অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। বন্ধ হয়েছে সিন্ধু চুক্তি, বন্ধ হয়েছে ভিসা। পাকিস্তানী ডিপ্লোম্যাটরা ইতিমধ্যেই দেশ ছাড়ছেন। সাম্প্রতিক পহেলগাঁও (pahalgam) হত্যালীলার প্রতিবাদ করতে গিয়ে সমাজ মাধ্যমে বাংলাপক্ষের পোস্ট কিছুটা আবেগ তাড়িত হলেও পূর্ণ যুদ্ধের দিকে ভারত যাবে কিনা তা একমাত্র সময়ে ই বলবে।