নয়াদিল্লি: পশ্চিমবঙ্গে ‘বাবরি মসজিদের প্রতিরূপ’ নির্মাণকে কেন্দ্র করে চলতে থাকা বিতর্কে নতুন করে আগুন জ্বালালেন ভারতীয় বৌদ্ধ সংঘের (Babri replica controversy) সভাপতি ভান্তে সংগপ্রিয় রাহুল। দেশজুড়ে উত্তাপ ছড়ানো এই ইস্যুতে তিনি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “দেশের কিছু মুসলমান যে স্বপ্ন দেখছেন, কিংবা বহিষ্কৃত তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন কবীর যা বলছেন— সেই স্বপ্ন কখনওই পূরণ হবে না।
বাবরের পূর্বপুরুষরাও জীবিত হয়ে এলে তা সম্ভব নয়।” তাঁর অভিযোগ, স্বাধীন ভারতের প্রেক্ষাপটে ‘আক্রমণকারী শাসকদের নাম স্মরণ করিয়ে রাখা’ কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই দেশের বিভিন্ন শহরে এই ধরনের আক্রমণকারীদের নামে থাকা রাস্তা, চত্বর ও স্থাপনার নাম বদলেরও দাবি তোলেন তিনি।
সংসদে বন্দেমাতরম উদযাপনে নেই রাহুল! সরব বিজেপি
ভান্তে সংগপ্রিয় রাহুলের এই মন্তব্য প্রকাশ্যে আসতেই রাজনৈতিক মহলে নতুন বিতর্কের সূচনা হয়েছে। তাঁর বক্তব্য, “দেশের সার্বভৌমত্ব এবং সামাজিক সম্প্রীয়তাকে বজায় রাখতে হলে ইতিহাসের ভুলগুলি সংশোধন করা জরুরি। যেসব নাম আজও আক্রমণের স্মৃতি জিইয়ে রাখে, সেগুলি বদল করা উচিত। দেশের মানুষ আর বিভেদের রাজনীতি সহ্য করবে না।”
এই মন্তব্যের উৎস পশ্চিমবঙ্গের নিলম্বিত তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন কবীরকে ঘিরে তৈরি হওয়া সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঝড়। ৪ ডিসেম্বর তাঁকে দল থেকে সাসপেন্ড করে তৃণমূল কংগ্রেস। কারণ হিসেবে জানানো হয়— ‘বিতর্কিত মন্তব্য’। এরপরই ৬ ডিসেম্বর মুর্শিদাবাদের বেলডাঙায় তিনি বাবরি মসজিদের আদলে একটি মসজিদের শিলান্যাস করেন। এই সিদ্ধান্ত নিয়েই দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া।
হুমায়ুন কবীর অবশ্য নিজের অবস্থানে অটল। তাঁর দাবি, তিনি “কোনও অসাংবিধানিক কাজ করেননি” এবং সংবিধানের অধিকার অনুযায়ী ধর্মীয় স্থাপনা নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন। রাজনৈতিক মহলে কানাঘুষো, ২২ ডিসেম্বর নিজের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ইঙ্গিতও দিয়েছেন তিনি।
ভান্তে সংগপ্রিয় রাহুলের বক্তব্য, এই ধরনের উদ্যোগ দেশের বিভাজনকেই বাড়িয়ে দেয়। তাঁর দাবি, “বাবর বা তাঁর মতো আক্রমণকারীরা এই দেশের ঐতিহ্য ছিলেন না। তাঁদের নামে স্থাপনা বা স্মৃতিস্তম্ভ থাকা উচিত নয়। স্বাধীন দেশের উচিত নিজেদের সাংস্কৃতিক আত্মসম্মান পুনরুদ্ধার করা।” তিনি আরও বলেন, “এ ধরনের ইস্যু তুলেই কিছু রাজনৈতিক নেতা নিজের আলোচনায় থাকতে চান। জনগণের প্রকৃত সমস্যা অর্থনীতি, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এই বিষয়গুলির দিকে মন দেওয়ার বদলে এমন সংবেদনশীল বিষয় উস্কে দেওয়া হচ্ছে।”
ঘটনাটি সামনে আসতেই এক্স (প্রাক্তন টুইটার)-এ শুরু হয় ব্যাপক চর্চা। অনেকেই ভান্তে সংগপ্রিয় রাহুলের মন্তব্যকে সমর্থন করে লেখেন দেশের নামকরণ এবং স্মৃতিস্তম্ভগুলিকে “ডিকলোনাইজেশন”-এর পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত। অন্যদিকে বিরোধী মতও উঠে এসেছে। কেউ কেউ অভিযোগ করছেন ANI এবং অন্যান্য সংবাদমাধ্যম “ইচ্ছাকৃতভাবে বিভাজনমূলক মন্তব্যকে হাইলাইট করে সরকারের ব্যর্থতা ঢাকতে চাইছে।”
সামাজিক মাধ্যমের আলোচনায় আবার ১৯৯২-এর বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং ২০২৪-এর অযোধ্যায় রাম মন্দির উদ্বোধনের প্রসঙ্গও উঠে এসেছে, যা প্রমাণ করে যে ইস্যুটি এখনও অত্যন্ত স্পর্শকাতর। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এই বিতর্ক চাপ বাড়িয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস হুমায়ুন কবীরের মন্তব্য থেকে নিজেদের দূরে রাখলেও বিরোধী দলগুলি অভিযোগ তোলায় যে— “এ ধরনের রাজনীতি রাজ্যের শান্তি ও সম্প্রীতি নষ্ট করছে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৬ বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই ধরনের ধর্মীয় মেরুকরণমূলক ইস্যু রাজ্যের রাজনৈতিক জল আরও ঘোলা করতে পারে। হুমায়ুন কবীরের শিলান্যাস এবং ভান্তে সংগপ্রিয় রাহুলের তীব্র প্রতিক্রিয়া দুই মিলে জাতীয় রাজনীতিতে নতুন বিতর্ক তৈরি করেছে।
কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক কিছু না বললেও, ঘটনার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ধর্মীয় পরিচয়, ঐতিহাসিক স্মৃতি এবং রাজনৈতিক স্বার্থ তিনের সংঘাতে নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে ‘বাবরি-স্বপ্ন’ এবং তার বাস্তবায়নের সম্ভাবনা।
