গুয়াহাটি: অসমের তরুণ হিতেশ বর্মনের মৃত্যু (Hitesh Barman murder case) আজও এক অমীমাংসিত রহস্য হয়ে রয়েছে। তিন বছর কেটে গেলেও পরিবারের কাছে সেই দিনটি যেন আজও থমকে আছে। পরিবারের অভিযোগ, এটি কোনো সাধারণ দুর্ঘটনা নয় এটি একটি পরিকল্পিত হত্যা, যার নেপথ্যে রয়েছে হিতেশের দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু, শফিকুর রহমান ও বনেস অলি।
বেঙ্গালুরুর একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত হিতেশ ওই দুই বন্ধুর সঙ্গে একই ফ্ল্যাটে থাকতেন। পরিবার জানিয়েছে, কিছুদিন ধরে শফিকুর ও বনেসের আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা যাচ্ছিল। তারা পরিকল্পিতভাবে হিতেশকে তার আগের বন্ধুদের থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং নতুন বাসায় স্থানান্তরিত হতে বাধ্য করে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হিতেশের মায়ের সঙ্গে শেষ ফোনালাপে সে বলেছিল, “আমার হাতে একটাও টাকা নেই, আমি বাড়ি ফিরব না।” অথচ আশ্চর্যের বিষয়, মাত্র দুই দিন পরই শফিকুর ও বনেসই তাকে টিকিট কেটে বাড়ি ফেরার জন্য রাজি করায়।
১৯ নভেম্বর, পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার চাঁচল থানার অন্তর্গত রেললাইনের পাশে হিতেশের নিথর দেহ উদ্ধার হয়। রেল পুলিশের মাধ্যমে পরিবার খবরটি জানতে পারে পরদিন বিকেলে। পরিবারের অভিযোগ, মৃত্যুর খবর পাওয়ার আগেই শফিকুর সেই রাতেই নিজের বাড়িতে ফিরে আসে, অথচ একবারের জন্যও পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।
পরিবারের সদস্যরা জানান, হিতেশের মৃতদেহের ছবি দেখানোর পর শফিকুর ঠান্ডা গলায় বলে, “হ্যাঁ, এটাই হিতেশ।” ঘনিষ্ঠ বন্ধুর এমন নির্লিপ্ত প্রতিক্রিয়া পরিবারকে আরও সন্দিহান করে তোলে। আরও আশ্চর্যের বিষয় মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে হিতেশ তার ভাই মিতুলকে ফোনে জানিয়েছিল, “আমার টাকা, মোবাইল সব নিয়ে গেছে।” অথচ দেহ উদ্ধারের সময় তার সঙ্গে ফোন, টাকা ও অন্যান্য সামগ্রী অক্ষত অবস্থায় মেলে।
এই বৈপরীত্যই পরিবারের সন্দেহকে গভীর করে তোলে। পরিবারের অনুরোধে শফিকুর ও বনেসকে মরদেহ আনতে মালদহে যেতে বলা হলে তারা হঠাৎই ফোন বন্ধ করে আত্মগোপন করে। তাদের বয়ানে একাধিক অসামঞ্জস্যতা পেয়ে তদন্তকারীরাও বিভ্রান্ত। সময় ও ঘটনার বিবরণ দুই বন্ধুর মুখে মেলে না।
পরিবারের বক্তব্য যদি ঘটনাটি সত্যিই একটি ডাকাতির মামলা হয়, তবে দুই বন্ধুর বক্তব্যে এমন পার্থক্য কেন?
তিন বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো সঠিক তদন্ত হয়নি বলে দাবি পরিবারের। তারা রাজ্য পুলিশ ও রেল পুলিশ উভয়কেই একাধিকবার লিখিতভাবে আবেদন করেছে। কিন্তু প্রতিবারই শুধু উত্তর এসেছে “তদন্ত চলছে।” পরিবারের কথায়, “তদন্ত যদি চলেই থাকে, তবে তিন বছর পরও কেন কোনো রিপোর্ট প্রকাশ হয়নি?”
হিতেশের মা আজও অপেক্ষা করছেন ন্যায়বিচারের জন্য। তাঁর কণ্ঠে শুধু একটাই আর্তি “আমার ছেলের মৃত্যুর সত্য প্রকাশ পাক। পুলিশ চুপ থাকলে অপরাধীরা আরও শক্তিশালী হবে।”
স্থানীয় সমাজকর্মীদের মতে, অসম ও পশ্চিমবঙ্গ উভয় রাজ্যের পুলিশের মধ্যে দায় এড়িয়ে চলার প্রবণতা এই মামলাটিকে আরও জটিল করে তুলেছে। একজন সমাজকর্মী বলেন, “একজন যুবকের রহস্যজনক মৃত্যুর তিন বছর পরও যদি ন্যায় না মেলে, তবে সেটি শুধুমাত্র এক পরিবারের নয়, সমগ্র সমাজের পরাজয়।”
বেঙ্গালুরু থেকে ঘরে ফেরার আনন্দ নিয়ে রওনা হয়েছিল হিতেশ। কিন্তু সেই যাত্রা শেষ হয়েছিল রেললাইনের পাশে এক নিথর দেহে। পরিবারের মতে, সেই মৃত্যু শুধুমাত্র এক তরুণের নয়, বরং বন্ধুতার বিশ্বাস, ন্যায়ের আশ্বাস এবং সমাজের নিরাপত্তার প্রতি আস্থার মৃত্যুও বটে।
আজও হিতেশ বর্মনের পরিবারের লড়াই অব্যাহত “আমরা ক্লান্ত, কিন্তু হার মানব না,” বলেন তার আত্মীয়। “যতদিন না দোষীরা শাস্তি পাচ্ছে, আমরা সত্যের জন্য লড়ে যাব।”


