কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ (Amit Shah) বৃহস্পতিবার জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে সংঘটিত জঙ্গি হামলার পর প্রথমবারের মতো জনসমক্ষে মুখ খুলে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারত প্রতিটি জঙ্গি কর্মকাণ্ডের উপযুক্ত ও নিখুঁত জবাব দেবে। গত ২২ এপ্রিল পহেলগাঁওয়ের বাইসারান মেডোতে পর্যটকদের উপর নৃশংস হামলার পর এটিই ছিল অমিত শাহের প্রথম সরকারি বিবৃতি। এই হামলায় ২৫ জন পর্যটক এবং একজন স্থানীয় বাসিন্দা প্রাণ হারিয়েছেন, যা সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হামলাগুলির মধ্যে একটি।
কঠোর হুঁশিয়ারি ও প্রতিশোধের প্রতিশ্রুতি
দিল্লিতে একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেওয়ার সময় অমিত শাহ জঙ্গিদের উদ্দেশে কঠোর বার্তা দিয়ে বলেন, “যদি কেউ মনে করে যে এই কাপুরুষোচিত হামলা তাদের জয়, তবে তাদের মনে রাখতে হবে এটি নরেন্দ্র মোদীর ভারত। আমরা একে একে প্রতিশোধ নেব।” তিনি আরও বলেন, “যারা পহেলগাঁওয়ে এই নৃশংস হামলা চালিয়েছে, তাদের কাউকে ছাড়া হবে না। প্রত্যেক জঙ্গিকে খুঁজে বের করে জবাবদিহি করতে হবে।” শাহ জোর দিয়ে বলেন, ভারত সরকারের লক্ষ্য দেশের প্রতিটি কোণ থেকে সন্ত্রাসবাদকে নির্মূল করা, এবং এই লক্ষ্য অবশ্যই পূরণ করা হবে।
তিনি বলেন, “আমি আবারও আমাদের প্রতিজ্ঞার কথা বলতে চাই—যতক্ষণ না সন্ত্রাসবাদ সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হচ্ছে, আমাদের এই লড়াই চলবে। যারা এই ধরনের হামলা চালিয়েছে, তাদের যথাযথ শাস্তি দেওয়া হবে।” শাহের এই বক্তব্য ভারতের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহনশীলতা’ নীতির প্রতিফলন। তিনি জানান, শুধুমাত্র ১৪০ কোটি ভারতীয়ই নয়, সারা বিশ্বের দেশগুলি এই লড়াইয়ে ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক সমর্থনের কথা উল্লেখ
অমিত শাহ জোর দিয়ে বলেন, পহেলগাঁও হামলার পর ভারতের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী লড়াইয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, “শুধু ভারতের ১৪০ কোটি মানুষ নয়, সমগ্র বিশ্ব ভারতের সঙ্গে এই লড়াইয়ে একত্রিত হয়েছে। বিশ্বের সমস্ত দেশ একযোগে ভারতের জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।” এই হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জাপান, চীন, রাশিয়া সহ একাধিক দেশ এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে ভারতের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছে।
পহেলগাঁও হামলার ভয়াবহতা
গত ২২ এপ্রিল পহেলগাঁওয়ের বাইসারান মেডোতে পাঁচজন সশস্ত্র জঙ্গি পর্যটকদের উপর হামলা চালায়। এই মেডোটি একটি মনোরম পর্যটন স্থান, যেখানে পৌঁছতে হয় হয় পায়ে হেঁটে বা পোনি সার্ভিসের মাধ্যমে। হামলাকারীরা পরিকল্পিতভাবে পুরুষদের আলাদা করে তাদের ধর্ম জিজ্ঞাসা করে গুলি চালায়। এই হামলায় ২৫ জন পর্যটক এবং একজন স্থানীয় বাসিন্দা সৈয়দ হুসেন শাহ নিহত হন। হুসেন শাহ পর্যটকদের পোনি সার্ভিস দিতেন এবং হামলাকারীদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রাণ হারান। এই হামলা ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার পর ভারতের সবচেয়ে মারাত্মক জঙ্গি হামলা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
অমিত শাহের তৎপরতা
হামলার সঙ্গে সঙ্গে অমিত শাহ শ্রীনগরে ছুটে যান এবং ২৩ এপ্রিল নিহতদের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলির প্রতি সমবেদনা জানান এবং নিহতদের দেহে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, “এই নৃশংস হামলার দোষীদের কোনওভাবেই রেহাই দেওয়া হবে না।” শাহ শ্রীনগরে একটি জরুরি নিরাপত্তা পর্যালোচনা বৈঠকও করেন এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে উত্তেজনা
পহেলগাঁও হামলার জন্য ভারত পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বার সঙ্গে যুক্ত ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ)-কে দায়ী করেছে। হামলার পর ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছেছে। ভারত সরকার একাধিক কঠোর পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে, যার মধ্যে রয়েছে ১৯৬০ সালের সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করা, পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা বাতিল করা এবং ভারতীয় আকাশসীমায় পাকিস্তানি বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করা। এছাড়া, ভারত পাকিস্তানে অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মীদের সংখ্যা ৫৫ থেকে কমিয়ে ৩০-এ নামিয়ে এনেছে। পাকিস্তানও পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য স্থগিত করেছে এবং ভারতীয় বিমানের জন্য তাদের আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে।
তদন্ত ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) হামলার তদন্তের দায়িত্ব নিয়েছে। তদন্তকারী দল জানিয়েছে, হামলার সঙ্গে জড়িত দুই পাকিস্তানি জঙ্গির মধ্যে একজন, হাসিম মুসা, পাকিস্তানের প্যারামিলিটারি ফোর্সে কাজ করতেন এবং পরে লস্কর-ই-তৈয়বায় যোগ দেন। নিরাপত্তা বাহিনী কাশ্মীরের বিভিন্ন জেলায় ১০ জন সন্দেহভাজন জঙ্গির বাড়ি ভেঙে ফেলেছে এবং ১,৫০০-র বেশি লোককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী, প্যারামিলিটারি ফোর্স এবং জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ যৌথভাবে তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে।
রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া
হামলার পর জম্মু ও কাশ্মীরে প্রতিবাদ ও শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা এবং পর্যটকরা এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়িয়েছেন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এবং শিবসেনার সঞ্জয় রাউত সহ বিরোধী নেতারা এই হামলার নিন্দা করেছেন এবং সরকারের পাশে থাকার কথা জানিয়েছেন। তবে, কেউ কেউ গোয়েন্দা ব্যর্থতার অভিযোগ তুলেছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও বলেছেন, “আমরা পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত গিয়ে হামলাকারীদের খুঁজে বের করব।”
পহেলগাঁও হামলা ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপর একটি বড় ধাক্কা হলেও, অমিত শাহের কঠোর বার্তা এবং সরকারের তৎপরতা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানের প্রতিফলন। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন করে উত্তেজনা এবং আন্তর্জাতিক সমর্থনের মধ্যে ভারত এখন কঠোর পদক্ষেপের দিকে এগোচ্ছে। এই হামলার প্রতিশোধ কীভাবে নেওয়া হবে, তা নিয়ে দেশবাসীর নজর এখন সরকারের উপর।