জাতীয় তদন্ত সংস্থা (NIA) আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ২০০৮ সালের ২৬/১১ মুম্বই সন্ত্রাসী হামলার অন্যতম মূল অভিযুক্ত তহব্বুর হুসেন রানাকে (Tahawwur Rana) দিল্লির একটি আদালতে হাজির করেছে। আমেরিকা থেকে প্রত্যর্পণের পর দিল্লিতে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেফতার করা হয়। রিপোর্ট অনুযায়ী, রানার নিজস্ব কোনও আইনজীবী না থাকায় সরকারের পক্ষ থেকে তাকে একজন আইনজীবী প্রদান করা হয়েছে। ২০০৯ সালে দায়ের করা একটি মামলার তদন্তের সূত্রে এনআইএ এখন তার হেফাজত চাইছে, যা মুম্বই হামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত।
এনআইএ-এর বিশেষ বিচারক চন্দর জিত সিং-এর সামনে রানাকে হাজির করা হয়। বর্তমানে তার হেফাজত নিয়ে আইনি যুক্তি-তর্ক চলছে। এনআইএ-এর পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করছেন সিনিয়র অ্যাডভোকেট দয়ান কৃষ্ণন এবং বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর নরেন্দ্র মান। অন্যদিকে, রানার প্রতিনিধিত্ব করছেন দিল্লি লিগ্যাল সার্ভিসেস অথরিটির অ্যাডভোকেট পিয়ুষ সচদেব।
এনআইএ এবং জাতীয় নিরাপত্তা গার্ড (এনএসজি)-এর একটি দল, যার মধ্যে ছিলেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে একটি বিশেষ বিমানে করে রানাকে দিল্লিতে নিয়ে আসে। এনআইএ-এর একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “তহব্বুর হুসেন রানা ডেভিড কোলম্যান হেডলি ওরফে দাউদ গিলানি এবং লস্কর-ই-তৈয়বা (এলইটি) ও হরকত-উল-জিহাদি ইসলামি (এইচইউজেআই)-এর মতো সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছিলেন। পাকিস্তানভিত্তিক অন্যান্য সহযোগীদের সঙ্গে মিলে তিনি ২০০৮ সালে মুম্বইয়ে এই ভয়াবহ হামলা চালিয়েছিলেন।”
দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছনোর পর এনআইএ-এর তদন্তকারী দল সমস্ত আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে রানাকে গ্রেফতার
করে। পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত এই কানাডিয়ান নাগরিক মূলত আমেরিকার শিকাগোতে বসবাস করতেন। গ্রেফতারের পর এনআইএ তার হেফাজতের ছবি প্রকাশ করেছে, যা এই ঘটনার গুরুত্বকে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে।
এনআইএ-এর বিবৃতি অনুসারে, বছরের পর বছর ধরে অবিরাম প্রচেষ্টার পর এই সন্ত্রাসী মাস্টারমাইন্ডের প্রত্যর্পণ সম্ভব হয়েছে। আমেরিকায় তার প্রত্যর্পণের বিরুদ্ধে শেষ মুহূর্তের আইনি লড়াই ব্যর্থ হওয়ার পর এনআইএ এই সাফল্য অর্জন করেছে। ভারত-মার্কিন প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় রানা আমেরিকায় বিচারিক হেফাজতে ছিলেন। এনআইএ-এর দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ফলেই আজ তাকে ভারতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
মুম্বই হামলা ও রানার ভূমিকা
২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর মুম্বইয়ে সংঘটিত এই হামলায় ১৬৬ জন নিহত এবং ২৩৮ জনেরও বেশি আহত হয়েছিলেন। লস্কর-ই-তৈয়বা এবং হরকত-উল-জিহাদি ইসলামি-র মতো সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে রানার বিরুদ্ধে। তিনি তার শৈশবের বন্ধু ডেভিড কোলম্যান হেডলির সঙ্গে মিলে এই হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন বলে জানা গেছে। হেডলি মুম্বইয়ে লক্ষ্যবস্তুর রেকি করার জন্য ভারতে এসেছিলেন, এবং রানা তাকে ভিসা ও ভুয়ো পরিচয়পত্র জোগাড় করে সাহায্য করেছিলেন। এছাড়াও, তিনি হেডলিকে অর্থ সরবরাহ এবং অন্যান্য লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ।
এনআইএ-এর তদন্তে প্রকাশ পেয়েছে যে, রানা কেবল হেডলির সহযোগী ছিলেন না, বরং পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। হামলার আগে তিনি ভারতের বিভিন্ন শহরে ভ্রমণ করেছিলেন এবং হেডলির সঙ্গে ফোনে কথা বলে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছিলেন। এই হামলায় মুম্বইয়ের আইকনিক স্থানগুলি যেমন ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস, তাজমহল হোটেল, নরিমান হাউস এবং কামা হাসপাতালকে টার্গেট করা হয়েছিল।
আইনি লড়াই ও প্রত্যর্পণ
রানার প্রত্যর্পণের জন্য ভারত বহু বছর ধরে আমেরিকার সঙ্গে আইনি ও কূটনৈতিক স্তরে লড়াই চালিয়ে আসছিল। ২০০৯ সালে আমেরিকার শিকাগোতে এফবিআই তাকে গ্রেফতার করে। সেখানে তাকে লস্কর-ই-তৈয়বার জন্য সহায়তা প্রদান এবং ডেনমার্কে একটি সন্ত্রাসী হামলার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তবে, মুম্বই হামলার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকার অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়েছিল। ১৪ বছরের কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষে ২০২০ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু ভারতের প্রত্যর্পণের আবেদনের পর তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়।
২০২৩ সালে আমেরিকার একটি আদালত তার প্রত্যর্পণের আদেশ দেয়। এর বিরুদ্ধে রানা একাধিক আইনি লড়াই চালান, যার মধ্যে ছিল আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টে আবেদন। তিনি দাবি করেছিলেন যে, ভারতে তাকে নির্যাতন করা হতে পারে। কিন্তু তার সমস্ত আবেদন খারিজ হয়ে যায়, এবং অবশেষে ২০২৫ সালের ৮ এপ্রিল তাকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
ভারতে আগমন ও ভবিষ্যৎ
দিল্লিতে পৌঁছনোর পর রানাকে তিহার জেলের একটি উচ্চ নিরাপত্তা ওয়ার্ডে রাখা হতে পারে বলে জানা গেছে। এনআইএ তার হেফাজত চেয়ে আদালতে আবেদন করেছে, যাতে তার থেকে আরও তথ্য সংগ্রহ করা যায়। তদন্তকারীরা আশা করছেন যে, রানার জিজ্ঞাসাবাদে পাকিস্তানের সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক এবং আইএসআই-এর ভূমিকা সম্পর্কে নতুন তথ্য প্রকাশ পাবে।
এই ঘটনা ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ২৬/১১ হামলার শিকারদের পরিবার এবং ভারতীয় জনগণের জন্য এটি ন্যায়বিচারের একটি আশার আলো। রানার বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হতে পারে, তবে এটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে।