২০২৫ সালে বাংলা সিনেমা (Bengali Films) একসময় সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন এবং ঋত্বিক ঘটকের মতো কিংবদন্তি পরিচালকদের হাত ধরে ভারতীয় চলচ্চিত্রের শীর্ষে পৌঁছেছিল৷ এখন বক্স অফিসে একের পর এক ব্যর্থতার মুখোমুখি হচ্ছে। টলিউডের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে চলচ্চিত্র প্রযোজক শ্রীকান্ত মোহতা, শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের নির্বাহী পরিচালক, সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে মুখ খুলেছেন। তিনি বাংলা সিনেমার বক্স অফিসে ব্যর্থতার কারণ এবং এর সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই প্রবন্ধে আমরা তাঁর মতামত এবং বাংলা সিনেমার বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করব।
বক্স অফিসে বাংলা সিনেমার দুরবস্থা
২০১৪ সালের একটি শিল্প প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলা চলচ্চিত্র শিল্প প্রতি বছর প্রায় ১২০টি সিনেমা মুক্তি দেয়, কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ১০-১২টি সিনেমা বক্স অফিসে সফল হয়। ২০২৩ সালে এই শিল্পের মোট রাজস্ব মাত্র ৬৬ কোটি টাকায় নেমে এসেছে, যেখানে ২০১৪ সালে এটি ছিল ১২০-১৫০ কোটি টাকা। এই পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায় বাংলা সিনেমার দর্শক ক্রমশ কমছে। প্রযোজক শ্রীকান্ত মোহতা বলেন, “বাংলা সিনেমার প্রধান সমস্যা হল দর্শকদের সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলা। আমরা এমন গল্প বলছি না যা শহুরে এবং গ্রামীণ উভয় দর্শকদের মন ছুঁয়ে যায়।”
কেন ব্যর্থ হচ্ছে বাংলা সিনেমা?
১. কনটেন্টের অভাব: মোহতা জানান, বাংলা সিনেমার বর্তমান সংকটের মূলে রয়েছে মানসম্পন্ন গল্পের অভাব। অনেক সিনেমা বলিউড বা দক্ষিণ ভারতীয় ছবির দুর্বল অনুকরণে পরিণত হয়েছে, যা দর্শকদের কাছে আকর্ষণীয় নয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত “মিথ্যে প্রেমের গান” ছবিটি ৫ কোটি টাকার বাজেটে তৈরি হলেও মাত্র ৩৩ লক্ষ টাকা আয় করেছে। এটি দর্শকদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছে।
২. দর্শকদের পরিবর্তিত রুচি: বাংলা সিনেমার ঐতিহ্য ছিল নিপুণ গল্প বলা এবং সমাজের প্রতিফলন ঘটানো। কিন্তু বর্তমানে দর্শকরা প্যান-ইন্ডিয়া ছবি যেমন “পাঠান” (১০৫০ কোটি টাকা) বা “জওয়ান” (১১৬০ কোটি টাকা) এর মতো বড় বাজেটের ছবির দিকে ঝুঁকছে। এই ছবিগুলি উচ্চ প্রযোজনা মান এবং বিনোদনের প্রতিশ্রুতি দেয়, যা বাংলা সিনেমা প্রায়শই দিতে ব্যর্থ হয়।
৩. থিয়েটারের অভাব ও ওটিটি প্ল্যাটফর্ম: বাংলায় সিনেমা হলের সংখ্যা জনসংখ্যার তুলনায় খুবই কম। জনসংখ্যার প্রতি মিলিয়নের জন্য গড়ে মাত্র ১.৭টি স্ক্রিন রয়েছে, যেখানে জাতীয় গড় ৮টি। এছাড়া, ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলি বাংলা সিনেমাকে তেমন গ্রহণ করছে না, কারণ এগুলির বক্স অফিসে পারফরম্যান্স দুর্বল। ফলে, বাংলা সিনেমার দৃশ্যমানতা এবং রাজস্ব কমছে।
৪. উচ্চ বাজেটের ঝুঁকি: মোহতা উল্লেখ করেছেন যে, বাংলা সিনেমার বাজেট বাড়ছে, কিন্তু রিটার্ন ততটা পাওয়া যাচ্ছে না। উদাহরণস্বরূপ, “চেঙ্গিজ” (২০২৩) ছবিটি ১০ কোটি টাকায় তৈরি হলেও মাত্র ৬.২৫ কোটি টাকা আয় করেছে। এই ধরনের আর্থিক ক্ষতি প্রযোজকদের বড় বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করছে।
কিছু ব্যতিক্রমী সাফল্য
কিছু বাংলা সিনেমা বক্স অফিসে সাফল্য অর্জন করেছে, যা শিল্পের জন্য আশার আলো। উদাহরণস্বরূপ, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায় পরিচালিত “বহুরূপী” (২০২৪) মুক্তির পর থেকে ১৬ কোটি টাকার বেশি আয় করেছে, যা এটিকে বাংলা সিনেমার সর্বোচ্চ আয়কারী ছবিগুলির মধ্যে একটি করে তুলেছে। এই ছবিটি গ্রামীণ বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে বাণিজ্যিক বিনোদনের মিশ্রণ ঘটিয়ে দর্শকদের মন জয় করেছে। একইভাবে, দেব অভিনীত “খাদান” ছবিটি তার প্রথম দিনেই ১ কোটি টাকা আয় করে রেকর্ড গড়েছে। এই সাফল্যগুলি প্রমাণ করে যে সঠিক গল্প এবং উচ্চ প্রযোজনা মান দর্শকদের ফিরিয়ে আনতে পারে।
প্রযোজকের দৃষ্টিকোণ
শ্রীকান্ত মোহতা বলেন, “আমাদের শহর ও গ্রামের দর্শকদের জন্য ভিন্ন ধরনের গল্প বলতে হবে। বাংলা সিনেমার শক্তি তার সাংস্কৃতিক শেকড়ে। আমাদের সেই শেকড়কে ধরে রাখতে হবে, কিন্তু আধুনিক দর্শকদের চাহিদা অনুযায়ী উপস্থাপন করতে হবে।” তিনি আরও জানান যে, বাংলা সিনেমাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দর্শকদের কাছে পৌঁছাতে হলে প্রচার বাজেট বাড়াতে হবে এবং বাঙালি প্রবাসীদের লক্ষ্য করতে হবে।
সমাধানের পথ
১. মানসম্পন্ন গল্প: মোহতা জোর দিয়ে বলেন, বাংলা সিনেমাকে তার ঐতিহ্যবাহী গল্প বলার ধরণে ফিরতে হবে। মালয়ালম সিনেমার মতো, যা সাংস্কৃতিক শেকড়ের সঙ্গে বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন করেছে, বাংলা সিনেমাকেও এমন গল্প বেছে নিতে হবে।
২. থিয়েটার ও ওটিটি: সিনেমা হলের সংখ্যা বাড়ানো এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বাংলা সিনেমার উপস্থিতি বাড়ানো জরুরি। “বহুরূপী” এবং “রক্তবীজ” এর মতো ছবিগুলি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তির আগেই বিক্রি হয়ে গেছে, যা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।
৩. প্রচার ও বিতরণ: বাংলা সিনেমার প্রচারে আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন। শ্রীকান্ত মোহতা পরামর্শ দিয়েছেন যে, বেঙ্গালুরু, মুম্বই এবং হায়দ্রাবাদের মতো শহরে বাঙালি প্রবাসীদের জন্য সপ্তাহান্তে নির্বাচিত মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা মুক্তি দেওয়া উচিত।
বাংলা সিনেমা একটি সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু এর সম্ভাবনা এখনও অপার। “বহুরূপী” এবং “খাদান” এর মতো ছবিগুলি প্রমাণ করে যে সঠিক গল্প এবং প্রযোজনা মান দিয়ে দর্শকদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব। প্রযোজক শ্রীকান্ত মোহতার মতে, বাংলা সিনেমাকে তার শেকড়ের সঙ্গে যুক্ত থেকে আধুনিক দর্শকদের চাহিদা পূরণ করতে হবে। সঠিক কৌশল এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলা সিনেমা আবারও জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে তার হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারে।