ভারতের বিনিয়োগ বৈচিত্র্যময় ভাষা ও সংস্কৃতির একটি গল্প। এই বৈচিত্র্যতা সময়ে সময়ে বিতর্কের কেন্দ্রে (Language Controversy) এসে পড়ে, যখন কোনো বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব তাদের ভাষা পছন্দ নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা এই বিতর্ককে আরও তীব্র করে তুলেছে। একদিকে বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় (Prosenjit Chatterjee) বাংলা ভাষাকে এড়িয়ে চলার অভিযোগের মুখে পড়েছেন, অন্যদিকে বলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী কাজল তাঁর হিন্দি ভাষা ব্যবহার এড়িয়ে মারাঠি ও ইংরেজিতে কথা বলে একটি নতুন বিতর্কের সূচনা করেছেন। এই দুটি ঘটনা ভারতের ভাষা রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়ে আবারও চিন্তনের বিষয় হয়ে উঠেছে।
প্রসেনজিৎ ও বাংলা ভাষার বিতর্ক
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, যিনি দীর্ঘদিন ধরে বাংলা সিনেমা জগতে অগ্রগতি করছেন, সম্প্রতি একটি নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষা ব্যবহারে অনীহা দেখানোর অভিযোগে ঘিরে গেছেন। এই ঘটনা প্রথমে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরে সংবাদ মাধ্যমে বড় আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। প্রসেনজিৎকে কেন্দ্র করে এই বিতর্ক শুরু হয়, যখন তিনি একটি জাতীয় অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ও হিন্দি ব্যবহার করেন। তাঁর এই পদক্ষেপকে অনেকে বাংলা সংস্কৃতির প্রতি অবহেলা হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
প্রসেনজিৎ পরে একটি বিবৃতিতে বলেন, “আমি কখনোই আমার মাতৃভাষা বাংলাকে অপমান করতে চাইনি। আমার উদ্দেশ্য ছিল শুধুমাত্র একটি বৃহত্তর শ্রোতার দিকে মনোযোগ দেওয়া।” তিনি দাবি করেন যে ভাষা ব্যবহার তাঁর কোনো রাজনৈতিক অথবা সাংস্কৃতিক অবহেলার প্রকাশ নয়। তবে এই ব্যাখ্যা অনেকের কাছে যথেষ্ট মনে হয়নি। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সমর্থকরা এই ঘটনাকে একটি বড় প্রতারণা হিসেবে দেখছেন এবং প্রসেনজিৎকে তীব্র সমালোচনার মুখে ফেলে দিয়েছে।
কাজলের মারাঠি-ইংরেজি পছন্দ
অন্যদিকে, কাজলের সাম্প্রতিক ঘটনা মহারাষ্ট্রে একটি মারাঠি চলচ্চিত্র পুরস্কার অনুষ্ঠানে ঘটে। এই অনুষ্ঠানে তিনি হিন্দি ভাষা ব্যবহারে অস্বীকার জানিয়ে মারাঠি ও ইংরেজিতে কথা বলেন। যখন সাংবাদিকরা তাঁকে হিন্দি ভাষায় কথা বলতে অনুরোধ করেন, তখন তিনি বলেন, “আমি এখন হিন্দি ভাষায় কথা বলব? যে বুঝতে চাইবে, বুঝবে।” এই বাক্যটি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে ওঠে এবং বিভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া আকর্ষণ করে।
কাজলের এই পদক্ষেপকে অনেকে তাঁর মাতৃভাষা মারাঠির প্রতি শ্রদ্ধা হিসেবে দেখছেন, যেহেতু তিনি মহারাষ্ট্রের একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছিলেন। তবে অন্যদিকে, হিন্দি ভাষা সমর্থকরা এই ঘটনাকে হিন্দি-বিরোধী হিসেবে প্রচার করছেন। তাঁদের মতে, কাজল যেহেতু বহু হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন, তাই তাঁর এই সিদ্ধান্তটি দ্বিমুখী হিসেবে মনে হয়। এই বিতর্কে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন যে, ভাষা ব্যবহার একটি ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয় এবং এর ওপর রাজনৈতিক চাপ দেওয়া উচিত নয়।
ভাষা ও পরিচয়ের দ্বন্দ্ব
ভারতের মতো বহুভাষী দেশে ভাষা ও পরিচয়ের দ্বন্দ্ব নতুন নয়। মহারাষ্ট্রে সম্প্রতি হিন্দি ভাষাকে প্রাথমিক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবে প্রবল বিরোধের পর এই ঘটনা আরও তীব্র রূপ নিয়েছে। মারাঠি ভাষার সমর্থকরা মনে করেন যে তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষা করা জরুরি, আর এই প্রসঙ্গে কাজলের পদক্ষেপ তাদের সমর্থন পেয়েছে। অন্যদিকে, হিন্দি ভাষাকে ভারতের একক ভাষা হিসেবে দেখার চেষ্টা প্রায়ই আঞ্চলিক ভাষার সমর্থকদের প্রতিবাদের মুখোমুখি হয়।
প্রসেনজিৎ ও কাজলের ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, ব্যক্তিগত পছন্দও কখনো কখনো বড় সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে পারে। বাংলা ও মারাঠি ভাষার প্রতি এই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মনোভাব তাদের জন্মভূমি ও কর্মভূমির প্রতি গভীর সম্পর্ককে প্রকাশ করতে পারে। তবে এই ঘটনাগুলো সামাজিক মাধ্যমে এবং সংবাদ মাধ্যমে এমনভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে যে, এটি কেবলমাত্র ব্যক্তিগত পছন্দের বাইরে গিয়ে একটি বৃহত্তর আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে।
সমাজের প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ
সামাজিক মাধ্যমে এই ঘটনার ওপর বিভিন্ন মতামত প্রকাশ পেয়েছে। কেউ কেউ প্রসেনজিৎ ও কাজলের পক্ষে দাঁড়িয়ে বলছেন যে তাদের ভাষা পছন্দ তাদের স্বাধীনতার প্রকাশ, আর অন্যরা এই পদক্ষেপকে ব্যবসায়িক স্বার্থের সঙ্গে জড়িত দেখছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে ভারতের মতো দেশে ভাষা নিয়ে বিতর্ক চলতে থাকবে, কারণ এটি শুধুমাত্র সংস্কৃতির প্রশ্ন নয়, বরং পরিচয় ও শক্তির প্রশ্নও।
অবশেষে, প্রসেনজিৎ ও কাজলের এই ঘটনা আমাদের এই প্রশ্নের দিকে নিয়ে যায়: কতটা দূরে আমরা আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে পারি, যেখানে ব্যক্তিগত পছন্দ ও সামাজিক দায়িত্বের সীমানা ধরা কঠিন? এই বিতর্ক থেকে যে কিছু শিক্ষা নেওয়া যায়, তা হলো ভাষা একটি সেতু হতে পারে, যদি তা বিভাজনের কারণ না হয়। ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা কীভাবে পরিচালিত হবে, তা নির্ভর করবে আমাদের সমাজের উদারতা ও বোধনের ওপর।