সৌন্দর্যের প্রচলিত ধারণা ভেঙে ‘বিস্ফোরক’ স্বীকারোক্তি কাল্কির

বলিউডের প্রতিভাবান অভিনেত্রী কল্কি কোচলিন (Kalki Koechlin) তাঁর জীবনের ব্যক্তিগত ও পেশাগত দিক নিয়ে সবসময়ই স্পষ্টবক্তা। সমাজের অবাস্তব সৌন্দর্যের মানদণ্ড নিয়ে তাঁর মতামত তিনি বারবার…

Kalki Koechlin Opens Up on Unrealistic Beauty Standards & Self-Doubt

বলিউডের প্রতিভাবান অভিনেত্রী কল্কি কোচলিন (Kalki Koechlin) তাঁর জীবনের ব্যক্তিগত ও পেশাগত দিক নিয়ে সবসময়ই স্পষ্টবক্তা। সমাজের অবাস্তব সৌন্দর্যের মানদণ্ড নিয়ে তাঁর মতামত তিনি বারবার প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের পডকাস্ট ডিয়ার ডটার-এ একটি এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে কল্কি নিজের মনের গভীর অনুভূতি শেয়ার করেছেন। তিনি বলেছেন, তিনি নিজেও মাঝে মাঝে “কুৎসিত” বোধ করেন। এই আধ ঘণ্টার অনুষ্ঠানে পিতামাতারা তাদের সন্তানদের উদ্দেশে চিঠি লেখেন, যেখানে তারা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও পরামর্শ দেন। কল্কি তাঁর পাঁচ বছরের মেয়ের জন্য লেখা এই চিঠিতে শরীরের চেহারা নিয়ে সমাজের চাপ এবং নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন।

কল্কি বলেন, “আমরা এমন একটি সমাজে বাস করি, যেখানে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বিকৃত হয়ে গেছে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে যে সৌন্দর্য মানে একটি নির্দিষ্ট আকার, একটি নির্দিষ্ট রঙ বা একটি নির্দিষ্ট আকৃতি।” তিনি তাঁর মেয়েকে পরামর্শ দিয়েছেন, কীভাবে এই অবাস্তব প্রত্যাশার মধ্যে নিজের আত্মবিশ্বাস বজায় রাখতে হয়। এই চিঠির পিছনের প্রেরণা সম্পর্কে কল্কি জানান, একদিন স্কুল থেকে ফিরে তাঁর মেয়ে বলেছিল, সে নিজেকে সুন্দর মনে করে না। “এত ছোট বয়সে তারা এত নিখুঁত হয়, আর আপনি ভাবেন, ‘ভগবান! কীভাবে সম্ভব যে তুমি নিজেকে সুন্দর মনে করছ না?’” এই ঘটনা তাঁকে গভীরভাবে ভাবিয়েছে এবং চিঠিটি লেখার প্রেরণা জুগিয়েছে।

“আমিও কখনো কখনো কুৎসিত বোধ করি”- Kalki Koechlin

চিঠিতে কল্কি স্বীকার করেছেন, তিনি নিজেও মাঝে মাঝে “কুৎসিত” অনুভব করেন, যদিও চারপাশের মানুষ তাঁকে বারবার সুন্দর বলে প্রশংসা করে। তিনি লিখেছেন, “আমাকে বিশ্ব ক্রমাগত বলে আমি সুন্দর, তবুও কখনো কখনো আমার মনে হয় আমি কুৎসিত।” এই স্বীকারোক্তি তাঁর সততা এবং সৌন্দর্য নিয়ে সমাজের চাপের প্রভাবকে তুলে ধরে। তিনি তাঁর মেয়েকে পরামর্শ দিয়েছেন, “তোমার জীবদ্দশায় সৌন্দর্যের মানদণ্ড বদলে যাবে। তাই সমাজ এখন যাকে সুন্দর বলে মনে করে, তার উপর খুব বেশি মূল্য দিও না।” কল্কির এই কথা শুধু তাঁর মেয়ের জন্য নয়, প্রতিটি মানুষের জন্য একটি শক্তিশালী বার্তা।

সৌন্দর্য নিয়ে সমাজের ভুল ধারণা

কল্কি দীর্ঘদিন ধরে বলিউডে এবং তার বাইরে সৌন্দর্যের অবাস্তব মানদণ্ড নিয়ে কথা বলে আসছেন। তিনি মনে করেন, মিডিয়া, বিজ্ঞাপন এবং ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি একটি নির্দিষ্ট চেহারাকে সৌন্দর্য হিসেবে চাপিয়ে দিয়েছে—যেমন ফর্সা ত্বক, সরু কোমর বা নিখুঁত গড়ন। এই চাপ কেবল নারীদের উপরই নয়, পুরুষদের উপরও পড়ছে। কল্কি বলেন, “এই ধারণা আমাদের নিজেদের প্রতি অসন্তুষ্ট করে তুলেছে। আমরা ভুলে যাই যে সৌন্দর্য আসলে আমাদের বৈচিত্র্যের মধ্যে লুকিয়ে আছে।” তিনি চান, তাঁর মেয়ে এই চাপ থেকে মুক্ত থেকে নিজেকে ভালোবাসতে শিখুক।

কল্কির নিজের অভিজ্ঞতা

কল্কি তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উদাহরণ দিয়ে বোঝান, কীভাবে তিনি এই অবাস্তব মানদণ্ডের শিকার হয়েছেন। ফরাসি বাবা এবং ভারতীয় মায়ের সন্তান হওয়ায় তাঁর চেহারা ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ‘আদর্শ সৌন্দর্য’ থেকে আলাদা। তিনি বলেন, “আমার ফর্সা ত্বকের জন্য অনেকে আমাকে সুন্দর বলে, কিন্তু আমি যখন নিজেকে আয়নায় দেখি, তখন মনে হয় আমি যথেষ্ট নই।” এই অনুভূতি তাঁকে বুঝিয়েছে যে, সৌন্দর্য বাইরের প্রশংসার উপর নির্ভর করে না, বরং নিজের মানসিক সন্তুষ্টির উপর। তিনি আরও বলেন, “আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন আমার নিজের চেহারা নিয়ে অনেক সন্দেহ ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে আমি শিখেছি, এটি আমার পরিচয়ের একটি অংশ।”

মেয়ের জন্য পরামর্শ

চিঠিতে কল্কি তাঁর মেয়েকে বলেছেন, “তোমার শরীর তোমার গল্প বলে। এটি তোমার জীবনের অভিজ্ঞতা, তোমার শক্তি এবং তোমার দুর্বলতার প্রতীক। এটাকে ভালোবাসো।” তিনি আরও যোগ করেছেন, “তোমার বন্ধুরা যদি বলে তুমি সুন্দর নও, তবে তাদের বলো, সৌন্দর্য শুধু চেহারায় নয়, মন এবং কাজের মধ্যেও থাকে।” এই পরামর্শ তাঁর মেয়ের জন্য একটি জীবনশিক্ষা, যা তাকে সমাজের বিচার থেকে মুক্ত রাখবে।

Advertisements

সৌন্দর্যের পরিবর্তনশীল ধারণা

কল্কি ইতিহাসের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, সৌন্দর্যের ধারণা সময়ের সঙ্গে বদলায়। “একসময় ভারতে গোলগাল শরীর সৌন্দর্যের প্রতীক ছিল, কারণ এটি সমৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যের লক্ষণ বলে গণ্য হতো। এখন সবাই সরু ফিগারের পিছনে ছুটছে। কে জানে, ভবিষ্যতে আবার কী হবে?” তিনি তাঁর মেয়েকে এই পরিবর্তনশীলতা বোঝাতে চান, যাতে সে বর্তমানের মানদণ্ডে নিজেকে বিচার না করে।

কল্কির জীবন ও দৃষ্টিভঙ্গি

কল্কি কোচলিন শুধু একজন অভিনেত্রী নন, তিনি একজন সচেতন মা এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ ব্যক্তি। তিনি তাঁর মেয়ে সাপফোকে ২০২০ সালে জন্ম দেন এবং সঙ্গী গাই হার্শবার্গের সঙ্গে গোয়ায় বসবাস করেন। তাঁর ফিল্মি ক্যারিয়ারে দেব ডি, জিন্দেগি ন মিলেগি দোবারা এবং মার্গারিটা উইথ এ স্ট্র-এর মতো সিনেমা তাঁকে খ্যাতি এনে দিয়েছে। তবে তিনি সবসময় বলিউডের গ্ল্যামারের বাইরে নিজের মতো করে জীবনযাপন করেছেন।

সমাজের জন্য বার্তা

কল্কির এই চিঠি তাঁর মেয়ের জন্য হলেও, এটি সমাজের প্রতিটি ব্যক্তির জন্য একটি বার্তা। তিনি বলেন, “আমাদের শিশুদের শেখাতে হবে যে সৌন্দর্য ভেতর থেকে আসে। আমরা যদি তাদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে পারি, তবে তারা এই চাপে ভেঙে পড়বে না।” এই কথা বাঙালি পরিবারের জন্যও প্রাসঙ্গিক, যেখানে মা-বাবারা তাদের সন্তানদের সমাজের বিচারের বাইরে নিজের মতো বড় হতে দেখতে চান।

কল্কি কোচলিনের “কখনো কখনো নিজেকে কুৎসিত মনে হয়” এই স্বীকারোক্তি আমাদের সবাইকে ভাবতে বাধ্য করে। তাঁর চিঠি তাঁর মেয়ের জন্য একটি জীবনশিক্ষা এবং আমাদের জন্য একটি আয়না। সৌন্দর্য কোনো নির্দিষ্ট ছাঁচে বাঁধা নয়, এটি আমাদের নিজস্বতায়। কল্কির এই কথা আমাদের শেখায়, নিজেকে ভালোবাসতে এবং সমাজের অবাস্তব মানদণ্ড থেকে মুক্ত হতে।