বাংলার সিনেমা কি হারিয়ে যাচ্ছে ডিজিটাল পর্দায়? পরিচালকরা কী ভাবছেন

বাংলা সিনেমার সমৃদ্ধ ইতিহাস সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনের মতো কিংবদন্তি পরিচালকদের হাত ধরে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছে। তবে, গত এক দশকে ওভার-দ্য-টপ (OTT)…

Is OTT Replacing Theatres for Bengali Films? Top Directors Share Their Views

বাংলা সিনেমার সমৃদ্ধ ইতিহাস সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনের মতো কিংবদন্তি পরিচালকদের হাত ধরে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছে। তবে, গত এক দশকে ওভার-দ্য-টপ (OTT) প্ল্যাটফর্ম যেমন নেটফ্লিক্স, আমাজন প্রাইম, হইচই এবং চরকির উত্থান বাংলা সিনেমার প্রেক্ষাগৃহে দর্শক সংখ্যার উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। একটি প্রতিবেদন অনুসারে, কলকাতার প্রায় ৫৪% দর্শক গত এক বছরে বাংলা সিনেমা দেখতে থিয়েটারে যাননি। এই পরিস্থিতিতে, বাংলা সিনেমার পরিচালকরা ওটিটি-র প্রভাব এবং থিয়েটারের ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবছেন? এই প্রবন্ধে আমরা কয়েকজন বিশিষ্ট পরিচালকের সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ তুলে ধরে এই বিষয়ে আলোচনা করব। এই সাক্ষাৎকারগুলি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন বিশিষ্ট পরিচালকরা৷

পরিচালকদের মতামত

   

১. পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়: অভিনেতা, পরিচালক ও প্রযোজক
পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, যিনি বাংলা ও হিন্দি সিনেমায় একাধিক ভূমিকায় কাজ করছেন, মনে করেন ওটিটি এবং থিয়েটার একে অপরের পরিপূরক হতে পারে। তিনি বলেন, “ওটিটি আমাদের গল্পকে বিশ্বব্যাপী দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। তবে, থিয়েটারের অভিজ্ঞতা অনন্য। ‘বহুরূপী’ বা ‘সন্তান’-এর মতো সিনেমা দেখিয়েছে যে ভালো কনটেন্ট থাকলে দর্শক এখনও হলে যান। আমাদের উচিত শহর ও গ্রামের দর্শকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সিনেমা তৈরি করা।” তিনি আরও বলেন, “কলকাতায় আমরা বড় বাজেটের বাণিজ্যিক সিনেমার পাশাপাশি পরীক্ষামূলক কাজের ভারসাম্য রাখতে হবে।” পরমব্রতের মতে, ওটিটি-র উত্থানে দর্শকদের পছন্দ বদলেছে, এবং নির্মাতাদের এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। (তথ্যসুত্র-হলিউড রিপোর্টার)

২. কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়: জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক
কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, যিনি ‘নগরকীর্তন’ এবং ‘পালান’-এর মতো সমালোচকপ্রশংসিত সিনেমা পরিচালনা করেছেন, মনে করেন বাংলা সিনেমার সমস্যা ওটিটি-র কারণে নয়, বরং নির্মাণের গুণগত মানের অভাবে। তিনি বলেন, “আমরা যদি ‘পথের পাঁচালী’ বা ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র মতো গল্প বলতে পারি, তবে দর্শক হলে আসবেন। ওটিটি আমাদের জন্য একটি সুযোগ, কারণ এটি আমাদের সিনেমাকে বিশ্বব্যাপী প্রচার করছে। কিন্তু আমরা যদি গুণগত মানের দিকে মনোযোগ না দিই, তবে দর্শক হারাব।” কৌশিক আরও বলেন, “আমাদের নতুন প্রজন্মের পরিচালকদের আরও সাহসী এবং মৌলিক হতে হবে।” তিনি মনে করেন, বাংলা সিনেমার গৌরব ফিরিয়ে আনতে গল্প এবং প্রযুক্তির মিশ্রণ জরুরি। (তথ্যসুত্র-টাইমস অফ ইন্ডিয়া)

৩. শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়: পরিচালক ও প্রযোজক
শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং নন্দিতা রায়ের জুটি ‘বেলাশেষে’, ‘প্রাক্তন’-এর মতো ব্যবসাসফল সিনেমার জন্য পরিচিত। শিবপ্রসাদ বলেন, “ওটিটি আমাদের শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে, হত্যা করেনি। কোভিডের সময় যখন থিয়েটার বন্ধ ছিল, ওটিটি আমাদের সিনেমাকে দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। তবে, আমাদের সমস্যা হলো মাল্টিপ্লেক্সে বলিউডের দাপট। বাংলা সিনেমা প্রায়শই প্রাইম টাইম স্লট পায় না।” তিনি আরও বলেন, “আমাদের ‘খাদান’-এর মতো সিনেমা দেখিয়েছে যে শহর ও গ্রামের দর্শকদের একত্রিত করা সম্ভব। আমাদের আরও থিয়েটার এবং ভালো মার্কেটিং দরকার।” শিবপ্রসাদের মতে, বাংলা সিনেমার প্রচারে ডিজিটাল মিডিয়ার ব্যবহার বাড়ানো জরুরি। (তথ্যসুত্র-হলিউড রিপোর্টার)

৪. সুদেষ্ণা রায়: পরিচালক ও অভিনেত্রী
সুদেষ্ণা রায়, যিনি বাংলা সিনেমা এবং টেলিভিশনে কাজ করছেন, মনে করেন ওটিটি একটি মিশ্র আশীর্বাদ। তিনি বলেন, “ওটিটি আমাদের গল্পকে বিশ্বব্যাপী নিয়ে গেছে, কিন্তু এটি দর্শকদের বাড়িতে বসে সিনেমা দেখার অভ্যাস তৈরি করেছে। ফলে, তারা থিয়েটারে যাওয়ার প্রেরণা কম পাচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “আমাদের শিল্পে সমস্যা শুধু ওটিটি নয়, টেকনিশিয়ান এবং পরিচালকদের মধ্যে দ্বন্দ্বও একটি বড় কারণ। গত বছর রাহুল মুখোপাধ্যায়ের ঘটনা এবং টেকনিশিয়ানদের বয়কট আমাদের শিল্পের ক্ষতি করেছে।” সুদেষ্ণা মনে করেন, শিল্পের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধান এবং দর্শকদের জন্য আকর্ষণীয় গল্প তৈরি করা জরুরি। (তথ্যসুত্র-দ্যি হিন্দু)

Advertisements

৫. অরিন্দম শীল: পরিচালক
‘মিতিন মাসি’ খ্যাত অরিন্দম শীল বলেন, “ওটিটি আমাদের জন্য একটি নতুন বাজার খুলে দিয়েছে। কিন্তু আমরা যদি শুধু ওটিটি-র জন্য সিনেমা বানাই, তবে থিয়েটারের সংস্কৃতি হারিয়ে যাবে। আমাদের এমন গল্প বানাতে হবে যা দর্শকদের হলে টানবে।” তিনি আরও বলেন, “বলিউডের মতো আমরা যদি বাংলা সিনেমার প্রচারে বিনিয়োগ করি, তবে দর্শক ফিরে আসবে। আমাদের দরকার নতুন প্রজন্মের নায়ক-নায়িকা এবং মৌলিক গল্প।” (তথ্যসুত্র-ওটিটি প্লে)

থিয়েটারের চ্যালেঞ্জ
২০১৪ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলা সিনেমার দর্শক সংখ্যা কমছে কারণ গল্পের সমসাময়িকতা এবং মানের অভাব রয়েছে। এছাড়া, মাল্টিপ্লেক্সে বলিউড সিনেমার প্রাধান্য এবং একক-পর্দা থিয়েটারের অভাব বাংলা সিনেমার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। গৌতম ঘোষের মতে, “আমাদের আরও ৫০টি নতুন থিয়েটার দরকার। পরিবারের সঙ্গে সিনেমা দেখার জন্য আরামদায়ক হল প্রয়োজন।” তিনি আরও বলেন, “ওটিটি আমাদের গল্পকে বিশ্বব্যাপী নিয়ে গেছে, কিন্তু থিয়েটারের জন্য আমাদের মার্কেটিং বাড়াতে হবে।”

আশার আলো
২০২৪ সালে ‘বহুরূপী’, ‘সন্তান’ এবং ‘খাদান’-এর মতো সিনেমা বাংলা সিনেমার জন্য আশার আলো দেখিয়েছে। এই সিনেমাগুলি শহর ও গ্রামের দর্শকদের একত্রিত করেছে। পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমাদের গল্পে নতুনত্ব এবং বৈচিত্র্য আনতে হবে। ওটিটি আমাদের পরীক্ষামূলক সিনেমার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম দিয়েছে, কিন্তু থিয়েটারের জন্য আমাদের বাণিজ্যিক ও শৈল্পিক ভারসাম্য রাখতে হবে।”

ওটিটি বাংলা সিনেমার জন্য একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম হলেও, এটি থিয়েটারের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিচালকরা মনে করেন, মৌলিক গল্প, ভালো মার্কেটিং এবং আরও থিয়েটারের মাধ্যমে বাংলা সিনেমা তার হারানো গৌরব ফিরে পেতে পারে। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, “আমাদের দর্শকদের মনে রাখতে হবে যে বাংলা সিনেমা শুধু বিনোদন নয়, আমাদের সংস্কৃতির প্রতিফলন।” তাই, ওটিটি এবং থিয়েটারের মধ্যে ভারসাম্য রেখে বাংলা সিনেমাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় এসেছে।