ব্রাহ্মণ সমাজের বিরুদ্ধে মন্তব্যে অনুরাগের বিরুদ্ধে মামলা

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা অনুরাগ কাশ্যপ (Anurag Kashyap ) সম্প্রতি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কথিত জাতিবাদী মন্তব্যের জন্য তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন। এই ঘটনা তাঁর সামাজিক মাধ্যমে…

Anurag Kashyap controversy

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা অনুরাগ কাশ্যপ (Anurag Kashyap ) সম্প্রতি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কথিত জাতিবাদী মন্তব্যের জন্য তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন। এই ঘটনা তাঁর সামাজিক মাধ্যমে করা একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে, যেখানে তিনি আসন্ন চলচ্চিত্র ‘ফুলে’-এর বিতর্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এই চলচ্চিত্রটি সমাজ সংস্কারক জ্যোতিরাও ফুলের জীবনীভিত্তিক, যিনি জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। কাশ্যপ এই চলচ্চিত্রের সেন্সরশিপ নিয়ে সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ফিল্ম সার্টিফিকেশন (সিবিএফসি)-এর সমালোচনা করেছিলেন। তবে তাঁর মন্তব্য অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়নি, ফলে তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক পুলিশ অভিযোগ দায়ের হয়েছে।

Advertisements

শনিবার, ইন্দোরে কাশ্যপের বিরুদ্ধে নতুন করে একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়। এমজি রোড পুলিশ স্টেশনের ইনচার্জ বিজয় সিং সিসোদিয়া সংবাদ সংস্থা এএনআই-কে জানিয়েছেন, “অনুপ শুক্লা নামে এক ব্যক্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা অনুরাগ কাশ্যপের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন। তিনি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের সামাজিক ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছেন এবং আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে।”

   

এছাড়াও, মুম্বাইয়ে আইনজীবী অশীষ রায় মুম্বাই পুলিশ কমিশনারের কাছে কাশ্যপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “সম্প্রতি ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে একটি বিতর্কিত মন্তব্য করা হয়েছে, যা ঘৃণাত্মক বক্তব্যের (হেট স্পিচ) আওতায় পড়ে। সুপ্রিম কোর্টের একটি রায় অনুযায়ী, সামাজিক মাধ্যমে এই ধরনের ঘৃণাত্মক কনটেন্ট প্রকাশ করা হলে অবশ্যই এফআইআর দায়ের করতে হবে এবং রাজ্যকে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে বিষয়টির আমল নিতে হবে। এই ধরনের মন্তব্য অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এই বিষয়ে আজ মুম্বাই পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ে একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, এবং আমরা এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।”

এই বিতর্কের মধ্যেই শুক্রবার রাতে কাশ্যপ সামাজিক মাধ্যমে একটি ক্ষমাপ্রার্টনা জারি করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, তাঁর মেয়ে, পরিবার, বন্ধু এবং সহকর্মীরা ধর্ষণ এবং মৃত্যুর হুমকি পাচ্ছেন। তবে তিনি স্পষ্ট করেছেন, তাঁর ক্ষমা তাঁর মূল পোস্টের জন্য নয়, বরং একটি মন্তব্যের জন্য, যা ‘প্রেক্ষাপট থেকে বিচ্ছিন্ন’ করে নেওয়া হয়েছে।

তাঁর ক্ষমাপ্রার্থনায় কাশ্যপ লিখেছেন, “এটি আমার ক্ষমা, আমার পোস্টের জন্য নয়, বরং সেই একটি লাইনের জন্য, যা প্রেক্ষাপট থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে। যা বলা হয়েছে তা ফিরিয়ে নেওয়া যায় না—আমি তা ফিরিয়েও নেব না। কিন্তু আপনারা যদি কাউকে গালিগালাজ করতে চান, তবে তা আমার দিকে নির্দেশ করুন। আমার পরিবার কিছুই বলেনি, তারা কখনোই কিছু বলে না।”

তিনি আরও যোগ করেন, “যদি আপনারা ক্ষমা চান, তবে এটাই আমার ক্ষমা। ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের কাছে আমার অনুরোধ, দয়া করে নারীদের রেহাই দিন—এমনকি আপনাদের শাস্ত্রেও এই ন্যূনতম শালীনতার কথা বলা আছে, শুধু মনুস্মৃতি নয়। আপনারা নিজেরাই স্থির করুন, আপনারা কেমন ব্রাহ্মণ। আমার পক্ষ থেকে, আমি আমার ক্ষমা প্রকাশ করছি।”

এই বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে ‘ফুলে’ চলচ্চিত্র, যা জ্যোতিরাও ফুলে এবং সাবিত্রীবাই ফুলের জীবনের উপর ভিত্তি করে নির্মিত। এই দম্পতি ১৯শ শতাব্দীতে জাতিভেদ এবং লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। চলচ্চিত্রটির মুক্তি মূলত ১১ এপ্রিল নির্ধারিত ছিল, কিন্তু অখিল ভারতীয় ব্রাহ্মণ সমাজ এবং পরশুরাম আরথিক বিকাশ মহামণ্ডলের মতো কিছু ব্রাহ্মণ সংগঠনের আপত্তির কারণে এটি স্থগিত করা হয়। তারা দাবি করেছে, চলচ্চিত্রটিতে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়কে নেতিবাচকভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। সিবিএফসি চলচ্চিত্রটিকে ‘ইউ’ সার্টিফিকেট প্রদান করেছে, তবে ‘মাং’, ‘মহার’, ‘পেশওয়াই’ এবং ‘৩০০০ সাল পুরানো গোলামি’র মতো শব্দ ও বাক্যাংশ সরানোর নির্দেশ দিয়েছে। পরিচালক অনন্ত মহাদেবন জানিয়েছেন, তারা এই পরিবর্তনগুলি মেনে নিয়েছেন, এবং চলচ্চিত্রটি এখন ২৫ এপ্রিল মুক্তি পাবে।

কাশ্যপের মন্তব্যটি একটি সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহারকারীর প্রতিক্রিয়ার জবাবে এসেছিল, যিনি লিখেছিলেন, “ব্রাহ্মণরা তোমার বাবা। তুমি যত তাদের সঙ্গে ঝগড়া করবে, তারা ততই তোমাকে পুড়িয়ে দেবে।” এর জবাবে কাশ্যপ লিখেছিলেন, “ব্রাহ্মণদের উপর আমি মূত্রত্যাগ করব… কোনো সমস্যা?” এই মন্তব্যটি দ্রুত ভাইরাল হয় এবং ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। অনেকে এটিকে জাতিবাদী এবং ঘৃণা ছড়ানোর মন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করেছেন।

Advertisements

মুম্বাইয়ে আইনজীবী অশুতোষ জে. দুবে, যিনি বিজেপি মহারাষ্ট্রের সোশ্যাল মিডিয়া আইনি ও পরামর্শক বিভাগের প্রধান, তিনি মুম্বাই পুলিশের কাছে কাশ্যপের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়েরের দাবি জানিয়েছেন। তিনি এক্স-এ পোস্ট করে বলেন, “আমি আনুষ্ঠানিকভাবে মুম্বাই পুলিশের কাছে অনুরাগ কাশ্যপের ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে করা অবমাননাকর ও জাতিবাদী মন্তব্যের জন্য এফআইআর দায়েরের আবেদন করেছি। এই ধরনের ঘৃণাত্মক বক্তব্য একটি সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। আইনের পথে এগোতে হবে।”

এই ঘটনায় রাজনৈতিক মহলেও প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। শিবসেনা (ইউবিটি)-এর সাংসদ প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদী বলেন, ব্রাহ্মণদের গালিগালাজ করা এখন “নতুন ফ্যাশন” হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি ব্রাহ্মণদের দ্বারা অতীতে সংঘটিত ঐতিহাসিক ভুলের বোঝা বহন করার কথা স্বীকার করলেও, পুরো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে “অবমাননাকর ও নোংরা” শব্দ ব্যবহারের বিরোধিতা করেন। এদিকে, কয়লা ও খনি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী সতীশ চন্দ্র দুবে কাশ্যপকে “নোংরা মুখের” বলে সম্বোধন করে তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার হুমকি দিয়েছেন।

কাশ্যপের এই বিতর্ক ভারতের জাতিগত সংবেদনশীলতা এবং মুক্ত মতপ্রকাশের মধ্যে চলমান উত্তেজনাকে তুলে ধরেছে। আইনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কঠোর বা আপত্তিকর বক্তব্য ঘৃণাত্মক বক্তব্যের আইনের আওতায় পড়তে পারে, তবে উদ্দেশ্য এবং প্রেক্ষাপট নির্ধারণ করা গুরুত্বপূর্ণ। এই ঘটনার তদন্ত এখনও চলছে, এবং মুম্বাই পুলিশ এখনও এফআইআর দায়েরের বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি।

এই বিতর্ক ‘ফুলে’ চলচ্চিত্রের মুক্তির আগে আরও জটিলতা সৃষ্টি করেছে। কাশ্যপ তাঁর মতামতের পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলেও, তাঁর পরিবার ও সহযোগীদের নিরাপত্তার জন্য তিনি জনসাধারণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। এই ঘটনা ভারতীয় সমাজে জাতি ও সিনেমার সংবেদনশীল সম্পর্কের উপর নতুন করে আলোকপাত করেছে।