বলিউডের চাকচিক্যের পিছনে একটি অন্ধকার দিক লুকিয়ে রয়েছে—পেইড রিভিউয়ের কেলেঙ্কারি (Bollywood Paid Reviews)। এই প্রথা, যেখানে প্রযোজকরা টাকার বিনিময়ে ইতিবাচক রিভিউ কিনে নেন, হিন্দি সিনেমার বিশ্বাসযোগ্যতার উপর গভীর প্রভাব ফেলছে। ২০২৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘আদিপুরুষ’ চলচ্চিত্রের বিতর্ক এই সমস্যার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। এই প্রতিবেদনে আমরা পেইড রিভিউয়ের অন্ধকার জগৎ, সামাজিক মাধ্যমে ম্যানিপুলেশন, দর্শকদের ভরসার উপর এর প্রভাব, এবং বক্স অফিসের পারফরম্যান্স নিয়ে আলোচনা করব, সঙ্গে থাকবে বিশেষজ্ঞদের মতামত এবং এক্স (X) প্ল্যাটফর্মে প্রতিক্রিয়া।
Read Hindi: बॉलीवुड का पेड रिव्यू स्कैंडल: क्या यह हिंदी सिनेमा की विश्वसनीयता को नुकसान पहुंचा रहा है?
পেইড রিভিউয়ের অন্ধকার জগৎ
বলিউডে পেইড রিভিউ কোনো নতুন বিষয় নয়। প্রযোজকরা প্রায়ই টাকার বিনিময়ে সমালোচক, ইউটিউবার, এবং সামাজিক মাধ্যমের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছ থেকে ইতিবাচক রিভিউ কিনে নেন। আল জাজিরার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “পেইড রিভিউয়ের এই সিস্টেমে নকল প্রশংসা, রেট কার্ড, হুমকি, এবং চাঁদাবাজি জড়িত।” এই প্রথা শুধু দর্শকদের বিভ্রান্ত করে না, বরং শিল্পের সততার উপরও প্রশ্ন তোলে।
২০১৬ সালে ‘আজয় দেবগন-কেআরকে-করণ জোহর’ বিতর্কে এই সমস্যা প্রকাশ্যে এসেছিল, যখন অভিযোগ উঠেছিল যে সমালোচক কেআরকে টাকার বিনিময়ে রিভিউ দিয়েছেন। সম্প্রতি, ২০২৪ সালে ‘জিগরা’ মুক্তির সময় ধর্মা প্রোডাকশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে সমালোচকরা প্রতি টুইটে ৬০,০০০ টাকা দাবি করছিলেন। এই ঘটনাগুলি প্রমাণ করে যে পেইড রিভিউ বলিউডে একটি গভীর সমস্যা।
আদিপুরুষ বিতর্ক: একটি কেস স্টাডি
২০২৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘আদিপুরুষ’, যা রামায়ণের উপর ভিত্তি করে নির্মিত, পেইড রিভিউয়ের একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। ৫০০ কোটি টাকার বাজেটে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে প্রভাস, কৃতি স্যানন, এবং সাইফ আলি খান অভিনয় করেছিলেন। মুক্তির আগে এটি ব্যাপক প্রচার পেয়েছিল, এবং কিছু সমালোচক ও মিডিয়া গ্রুপ এটিকে “ম্যাগনাম ওপাস” বলে চার তারকা রেটিং দিয়েছিল। তবে, মুক্তির পর দর্শক ও সমালোচকরা চলচ্চিত্রটির দুর্বল ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট, অপমানজনক সংলাপ, এবং রামায়ণের অসম্মানজনক উপস্থাপনার জন্য তীব্র সমালোচনা করেন।
এক্স প্ল্যাটফর্মে গুজব ছড়ায় যে টি-সিরিজ, চলচ্চিত্রটির প্রযোজক, নেতিবাচক পোস্ট মুছে ফেলার জন্য এবং ইতিবাচক রিভিউ পোস্ট করার জন্য এক্স-এর জনপ্রিয় অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের টাকা অফার করেছিল। একটি এক্স পোস্টে দাবি করা হয়, “আদিপুরুষ টিম আমাকে প্রতি টুইটে ৯,৫০০ টাকা দিচ্ছে ইতিবাচক রিভিউ পোস্ট করার জন্য।” যদিও এই দাবিগুলি যাচাই করা যায়নি, তবুও এটি দর্শকদের মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টি করেছে। বিশিষ্ট পরিচালক হানসাল মেহতা আল জাজিরাকে বলেন, “পিআর এখন পেইড রিলেশন হয়ে গেছে। আপনি জানেন না কী ভালো, কী খারাপ, কী সঠিক, কী ভুল।”
দর্শকদের ভরসা ও বক্স অফিসে প্রভাব
পেইড রিভিউ দর্শকদের ভরসার উপর গভীর প্রভাব ফেলছে। আদিপুরুষের ক্ষেত্রে, প্রাথমিকভাবে চলচ্চিত্রটি উদ্বোধনী সপ্তাহান্তে ৩৪০ কোটি টাকা আয় করেছিল, তবে নেতিবাচক মুখের কথার কারণে এর বক্স অফিস সংগ্রহ দ্রুত হ্রাস পায়। শেষ পর্যন্ত, হিন্দি সংস্করণটি মাত্র ১৩০ কোটি টাকা আয় করে, যা এর বিশাল বাজেটের তুলনায় ব্যর্থতা। ট্রেড বিশ্লেষক কোমল নাহটা বলেন, “৯০% সাংবাদিক রিভিউয়ের জন্য নগদ বা অন্যান্য সুবিধা গ্রহণ করছেন।” এই প্রথা দর্শকদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, কারণ তারা আর বুঝতে পারেন না কোন রিভিউ সত্যি।
পেইড রিভিউ শুধু দর্শকদের বিভ্রান্ত করে না, বরং বক্স অফিসের সংগ্রহকেও প্রভাবিত করে। হিন্দুস্তান টাইমসের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বক্স অফিসের সংগ্রহের ‘ইনফ্লেশন’ এখন প্রযোজকদের জন্য একটি পিআর টুল। যখন দর্শকরা বুঝতে পারেন যে তারা মিথ্যা প্রশংসার উপর ভিত্তি করে টিকিট কিনেছেন, তখন তারা হতাশ হন এবং ভবিষ্যতে সিনেমা দেখতে অনীহা প্রকাশ করেন।
এক্স প্ল্যাটফর্মে প্রতিক্রিয়া
এক্স প্ল্যাটফর্মে পেইড রিভিউ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ২০২৫ সালের মার্চে, সাংবাদিক সুপর্ণা শর্মা একটি পোস্টে বলেন, “বলিউডের পেইড রিভিউ শিল্পকে ধ্বংস করছে।” অন্য একটি পোস্টে বলা হয়, “পিআর ফার্মগুলি রেট কার্ড পাঠায়, যেখানে ইতিবাচক পোস্ট, টুইট, এবং মিমের দাম উল্লেখ থাকে।” এই পোস্টগুলি দর্শকদের মধ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করে এবং বলিউডের স্বচ্ছতার অভাব নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পেইড রিভিউ বলিউডের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি করছে। ট্রেড বিশ্লেষক অতুল মোহন বলেন, “বক্স অফিসের সংগ্রহের ম্যানিপুলেশন শিল্পে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে।” তিনি আশা প্রকাশ করেন যে দর্শকদের সচেতনতা এই প্রথার অবসান ঘটাতে পারে। ধর্মা প্রোডাকশনের মতো কিছু প্রযোজনা সংস্থা পেইড রিভিউয়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন প্রি-রিলিজ স্ক্রিনিং বন্ধ করা। তবে, এই সমস্যার সমাধানের জন্য শিল্পের সামগ্রিক সংস্কার প্রয়োজন।
পেইড রিভিউয়ের কেলেঙ্কারি বলিউডের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং বক্স অফিসের সাফল্যের জন্য হুমকি। আদিপুরুষের মতো ঘটনা প্রমাণ করে যে নকল প্রশংসা শুধুমাত্র স্বল্পমেয়াদী লাভ এনে দিতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে দর্শকদের ভরসা এবং শিল্পের খ্যাতি নষ্ট করে। স্বচ্ছতা এবং সততার মাধ্যমে বলিউডকে এই সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে, যাতে দর্শকরা আবার সিনেমার উপর ভরসা করতে পারেন।