ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতর থেকে উঠে এসেছে এক চমকপ্রদ ও চিন্তাজনক তথ্য। শিক্ষা মন্ত্রকের সর্বশেষ UDISE+ ২০২৪-২৫ রিপোর্ট জানাচ্ছে, দেশে এখনও ১ লক্ষ ৪ হাজার ১২৫টি স্কুল একজন শিক্ষকের উপর নির্ভরশীল। আর এই স্কুলগুলোতে পড়াশোনা করছে প্রায় ৩৩ লক্ষ ৭৬ হাজার ছাত্রছাত্রী। অর্থাৎ, লক্ষ লক্ষ শিশুর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে একক শিক্ষকের সীমিত সময় ও সামর্থ্যের উপর।
গ্রামীণ ও দূরবর্তী অঞ্চলে সমস্যা সবচেয়ে বেশি
রিপোর্ট বলছে, একজন শিক্ষককে একাধিক ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের একসাথে পড়াতে হচ্ছে—বিশেষ করে গ্রামীণ ও দুর্গম এলাকায়। যেখানে অবকাঠামো ও জনবল দুটোই অপ্রতুল। ফলে শিক্ষার মান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
কোন রাজ্যে সবচেয়ে বেশি একক শিক্ষক স্কুল?
রাজ্যভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী—
- আন্ধ্র প্রদেশে সর্বাধিক ১২,৯১২টি স্কুল (মোটের ১২%)
- উত্তর প্রদেশে ৯,৫০৮টি
- ঝাড়খণ্ডে ৯,১৭২টি
- মহারাষ্ট্রে ৮,১৫২টি
- পশ্চিমবঙ্গে ৬,৪৮২টি
এই তথ্য স্পষ্ট করে দিচ্ছে, শিক্ষক নিয়োগে দীর্ঘদিন ধরেই গুরুতর ঘাটতি রয়েছে।
রাইট টু এডুকেশন আইনের লঙ্ঘন
RTE Act, ২০০৯ অনুযায়ী প্রাথমিক স্তরে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত (PTR) হওয়া উচিত ৩০:১, আর উচ্চ প্রাথমিক স্তরে ৩৫:১। কিন্তু বাস্তবে—
- আন্ধ্র প্রদেশে অনুপাত ৪২:১
- উত্তর প্রদেশে ৪০:১
অর্থাৎ আইন মানা হচ্ছে না, আর এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে শিক্ষার গুণমানের উপর।
সাম্প্রতিক পরিবর্তন
২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে একক শিক্ষক স্কুলের সংখ্যা ছিল ১,১৮,১৯০। ২০২৪-২৫-এ তা কমে দাঁড়িয়েছে ১,০৪,১২৫। অর্থাৎ প্রায় ১২% হ্রাস হয়েছে। সরকার বলছে, শূন্য ছাত্রসংখ্যার স্কুল থেকে শিক্ষক স্থানান্তর ও স্কুল একত্রীকরণ (rationalisation) করার ফলেই এই পরিবর্তন।
কিন্তু শিক্ষাবিদরা মনে করছেন, শুধু পুনর্বিন্যাস যথেষ্ট নয়। প্রকৃত সমাধান হল নতুন শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষা খাতে বড় বাজেট বরাদ্দ।
শিক্ষা বাজেটে কাটছাঁট
আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো বাজেট বরাদ্দ।
- ২০১৪ সালে জাতীয় বাজেটের ৪.৬% শিক্ষায় ব্যয় করা হতো।
- ২০২৪-২৫-এ তা নেমে এসেছে মাত্র ২.৫%-৩%-এ।
যেখানে কোঠারি কমিশন বহু আগেই সুপারিশ করেছিল জিডিপির ৬% শিক্ষায় খরচ করার জন্য। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি।
পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা
পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে ৬,৪৮২টি একক শিক্ষক স্কুল। রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা ও বিশেষ করে গ্রামীণ স্কুলগুলিতে এর প্রভাব মারাত্মক। শিক্ষাবিদদের মতে, অবিলম্বে শিক্ষক নিয়োগ বাড়ানো এবং গ্রামীণ স্কুল সংস্কারে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া
এই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসতেই সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকের মতে, কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারেরই সমান দায়িত্ব রয়েছে। শিক্ষা ছাড়া উন্নয়নের স্বপ্ন পূরণ সম্ভব নয়। আর এক লক্ষেরও বেশি স্কুল একজন শিক্ষকের উপর ভরসা করে চলছে—এটাই প্রমাণ করছে যে ভারতের শিক্ষা খাত এখনও কাঠামোগত সংকটে ভুগছে।
শিক্ষা শুধু একটি মৌলিক অধিকার নয়, এটি উন্নয়নের ভিত্তি। অথচ লক্ষ লক্ষ শিশু এখনও মানসম্পন্ন শিক্ষার বাইরে থেকে যাচ্ছে একজন শিক্ষকের অভাবে। সময় এসেছে বাজেটে অগ্রাধিকার দেওয়া ও শিক্ষক নিয়োগে বিপুল উদ্যোগ নেওয়ার। না হলে “নতুন ভারতের” স্বপ্ন অনেকাংশেই অপূর্ণ থেকে যাবে৷