বিমানের ভাড়া দিচ্ছে কোন গৌরী সেন?

আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য হোল ভোটের প্রচারে কখনও জনতা জনার্দনের মূল সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা হয়না। পরিবর্তে খেউর হয় অপ্রাসঙ্গিক, মতলবী, জনস্বার্থসম্পর্ক রহিত কতকগুলি বিষয়…

Which Gauri Sen is Paying Mamata Banerjee's Plane Fare

আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য হোল ভোটের প্রচারে কখনও জনতা জনার্দনের মূল সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনা হয়না। পরিবর্তে খেউর হয় অপ্রাসঙ্গিক, মতলবী, জনস্বার্থসম্পর্ক রহিত কতকগুলি বিষয় নিয়ে। আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গ সেই নিয়মে ব্যতিক্রম নয়। অথচ ভোট এসেছে বলে আমার-আপনার সমস্যাগুলি তো থেমে থাকবেনা, বরং আরও বেশি বেশি করে বাড়ছে। আজ তাই মনে হল দাগী রাজনীতিকদের কথা অনেক হোল, এবার একটু গৃহমুখী হওয়া যাক।

এপ্রিল মাসের বিদ্যুৎ বিল ডাকবাক্সে ঢোকার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একরকম মাথায় হাত পড়েছে রাজ্যবাসীর। নানা জনে নানা ভাবে বিবিধ সামাজিক মাধ্যমে পন্ডিতি ফলালেও কোনও বড় কাগজ অথবা খবরের চ্যানেল, সাহস করে ঘন্টাখানেক আলোচনায় বসার সাহস দেখায়নি এখনও। কোনও নিউজ অ্যাঙ্করের প্রশ্নবাণ তো দূরে বিষয়টি উচ্চারিত হয়েছে ‘অশ্বত্থমা হত ইতি গজ’-র স্টাইলে। মানে বুড়ি ছোঁয়া মাত্র।

   

সত্যিই কি ভয়ংকর বৃদ্ধি ঘটেছে মাসিক বিদ্যুৎ বিলে– যেখানে বেসরকারি সেক্টরের কথা ছেড়েই দিলাম, মহার্ঘ ভাতা না পাওয়া সরকারি কর্মীদের-ও কি বিদ্যুৎ বিল দিতে গিয়ে বিদ্যুৎপৃষ্ট হওয়ার অবস্থা হয়েছে ?

বিষয়টি জটিল তাই কিঞ্চিৎ সবিস্তার আলোচনা প্রয়োজন। প্রতিটি রাজ্যে বিদ্যুতের দাম এবং আনুষঙ্গিক বিষয়গুলি নির্ধারণ করে রাজ্য বিদ্যুৎ রেগুলেটরি কমিশন। আর কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রণাধীন সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে তা ঠিক করে সেন্ট্রাল ইলেকট্রিসিটি রেগুলেটরি কমিশন ( সিইআরসি)। পশ্চিমবঙ্গে যার নাম স্টেট ইলেকট্রিসিটি রেগুলেটরি কমিশন (এস ই আর সি)। এই সংস্থাগুলি কোয়াসি জুডিশিয়াল বডি হলেও, রাজ্য সরকার বকলমে এই সংস্থাগুলিকে চালায় নিজের পছন্দের অবসরপ্রাপ্ত আমলা দিয়ে। তবে ব্যতিক্রম অবশ্যই থাকে। যেমন ছিলেন প্রসাদরঞ্জন রায়।

এবার আসা যাক, মূল্য বৃদ্ধির ইস্যুতে। প্রতি বছর নভেম্বর মাসে সমস্ত পাওয়ার ইউটিলিটিগুলি এসইআরসির কাছে দাম বৃদ্ধির করার আবেদন জানায়। নির্নায়ক সংস্থার আধিকারিকরা সেই আবেদনগুলির ওপর শুনানি করেন, তারপর প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়।এই দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার ক্ষমতার মধ্যে আবার কিছুটা ফারাক আছে যা আইনত সিদ্ধ। যেমন কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন একটি বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকে যা রাজ্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলির নেই।কয়লার বাজারি দামের ওপর ভিত্তি করে এনটিপিসি নিজেরাই বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করতে পারে, তার জন্য প্রতি বছর নিয়ম করে আর সিইআরসির কাছে আবেদন করতে হবে না। বাকি রইল সংবহন বা ট্রান্সমিশন কোম্পানি এবং বন্টন বা ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি।এদের অবস্থা এক্কেবারে দুয়োরানীর। জেনারেশন বা বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সংস্থাগুলি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করে বছর বছর কিন্তু তাদের সঙ্গে বিদ্যুত সংবহন করা সংস্থা এবং ঘরে ঘরে বিদ্যুত বন্টনকারী সংস্থাগুলির মাশুল বৃদ্ধি হয়না। তাদের পৃথকভাবে আবেদন জানাতে হবে এসইআরসির কাছে। এই নিয়ম কিন্তু নতুন নয়। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস জমানা, বাম জমানাতেও ছিল। এখন তৃণমূল কংগ্রেস জমানাতেও চলছে।

তবে কংগ্রেস বা বাম শাসনকালে বকলমে সিইআরসি-র ওপর খবরদারি চালানো হোত না। পছন্দের অবসরপ্রাপ্ত আমলাকে চেয়ারম্যান পদে বসানো হোত না প্রাইভেট সেক্টরের বাড়তি সুবিধে করে দিতে। কিন্তু এই জমানায় সেই চালু প্রথা গুমঘরে চালান করে দেওয়া হয়েছে। এখন সিইআরসি-র চেয়ারম্যান পদে কে বসবেন তার যোগ্যতার মানদন্ড হয় একটাই। তিনি সিইএসসি-র মালিকের বশংবদ হবেন কীনা।

বামফ্রন্ট জমানায় গোয়েঙ্কারা যখন বছর বছর মাশুল বৃদ্ধি করতেন তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চিৎকার করে তার প্রতিবাদ করতেন। ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে ধর্ণা-বিক্ষোভ লেগেই থাকত। জ্যোতিবাবুর জমানায় বলা হোত তিনি নাকি বিনে পয়সায় সি ই এস সি গোয়েঙ্কাদের হাতে তুলে দিয়েছেন আর তাঁর পুত্র চন্দন তার সুবিধা নিচ্ছে। বাম জমানায় বিদ্যুৎ মন্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র শঙ্কর সেন গোয়েঙ্কাদের সবক শেখাতে আদা জল খেয়ে নেমেছিলেন অথচ শেষ পর্যন্ত তিনি বিরক্ত হয়ে রণেভঙ্গ দিলেন, গোয়েঙ্কাদের মৌরসি পাট্টা অব্যাহত রইল। মমতা তো একবার বিদ্যুৎ মাসুল বৃদ্ধির পরে সোজা ধর্মতলায় আমরণ অনশনে বসে পড়েছিলেন, তাঁকে নিরস্ত করতে সে সময় গোয়েঙ্কাদের কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। ক্ষমতার লোভ এমনই বস্তু যা সোনাকেও পাথর করে দিতে পারে সৎকে চূড়ান্ত অসৎ। দিদিমনির কেন এই গভীর গোয়েঙ্কা প্রেম তা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে ইলেকটোরাল বন্ড কিসসা বাইরে আসার পরে। যে সংস্থা একটি সামান্য আঞ্চলিক দলকে তিনশ কোটি টাকা উপঢৌকন দেয়, তারা তো খুশি মতো বিদ্যুতের মাসুল বাড়াবেই। ভুগবে জন-গণেশ, বেপরোয়া মুনাফা লুটবে বেওসায়ী আর শাসক বিমান ভাড়া করে ভোট ভিক্ষা করবে, এটাই আজ দস্তুর। বাহবা নন্দলাল! (চলবে)