কেন মুজিবুর রহমান খুন? Kolkata 24×7 প্রকাশ করছে সিরিজ। এই সিরিজের মূল লক্ষ্য, মুজিব হত্যার নেপথ্য অংশগুলি দেখা। (The story behind the assassination of Sheikh Mujibur Rahman)
প্রসেনজিৎ চৌধুরী: ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’ তাজউদ্দিন আহমদ। কে বলবে তিনি বিশ্বজোড়া আলোচিত নেতা। দিন রাত একলা থাকেন। বাইরে জনচঞ্চল ঢাকা নগরের শব্দ তাঁর ঘরের চৌকাঠে এসে থমকে যায়। কড়িকাঠের দিকে আলস্যে চেয়ে থাকেন তাজউদ্দিন। বই পড়েন। সময়ের ক্রূর হাসি তিনি স্পষ্ট শুনতে পান। ফেলে আসা সশস্ত্র সংগ্রামের ঝোড়ো দিনগুলির স্মৃতি হাতড়ে যান। কলকাতার স্মৃতি। তখন তিনি প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী। কলকাতা থেকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছেন। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করছেন।
১৯৭১ সালে কলকাতা থেকে পরিচালিত হচ্ছিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার (মুজিব নগর সরকার)। সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ তাঁর বালিগঞ্জের কার্যালয়ের ছোট্ট কামরা থেকে যুদ্ধ জয়ের গন্ধ পাচ্ছিলেন। বালিগঞ্জের সেই বাড়ি ঐতিহাসিক। দেশি-বিদেশি কূটনীতিক, সাংবাদিকের আনাগোনা লেগেই থাকে। খুব সাধারণভাবে থাকা তাজউদ্দিন আহমদকে দেখে সকলেই চমকে যান। এ কী রে বাবা! এই লোকটা প্রধানমন্ত্রী নাকি! কথাবার্তা বা সাক্ষাৎকার শুরু হলে তাজউদ্দিনের মাপা কথার মাঝে কূটনৈতিক বাক্য বড় বড় সংবাদ শিরোনাম তৈরি করে দেয়।
যুদ্ধ চলছিল। তাজউদ্দিন আহমদকে মাঝে মধ্যেই নিজেদের দখলকৃত এলাকা পরিদর্শনে যেতে হচ্ছিল। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁকে সামরিক অভ্যর্থনা জানাতেন বাংলাদেশি মুক্তিবাহিনীর কমান্ডাররা। তখন তাজউদ্দিনের পরতে জংলা রঙের বুশ শার্ট পোশাক। ঝড়ের গতিতে অধিকৃত এলাকা পরিদর্শন করে তিনি কলকাতায় ফিরে আসতেন। প্রবাসী সরকারের কার্যালয়ে তাঁর সংবাদ সম্মেলনে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে চমকদার খবর থাকত।
যুদ্ধ শেষে পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত। বাংলাদেশ তৈরি হল। কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ। তাঁকে সামরিক মর্যাদায় বরণ করা হল।
যুদ্ধকালীন সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বন্দি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। তিনি মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসলেন। জনসমুদ্রে শেখ সাহেবকে বরণ করা হল। তাঁর বিশ্বব্যাপী পরিচিতি। তিনিই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতা। তাঁরই অনুগত তাজউদ্দিন আহমদ স্বেচ্ছায় প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়লেন। তবে ঢাকার কূটনৈতিক মহলে শুরু হল গুঞ্জন এভাবে তাজউদ্দিনকে সরানো কি ঠিক হল?
প্রধানমনমন্ত্রীর পদ ছেড়ে তাজউদ্দিন একলা। তিনি ঘরে বসেই চারিদিকে নজর রাখেন। গোপনে জানতে পারলেন মুজিবুর রহমানকে খুনের চক্রান্ত চলছে। এমন খবর পেয়ে শিহরিত তাজউদ্দিন। তবে তিনি নীরবই থাকলেন। এ সংবাদ তিনি যাচাই না করে কাউকে বলতেও পারেন না। পরিস্থিতি এমনই যে তার সঙ্গেই বেশ দূরত্ব রাখছিলেন খোদ মুজিবুর রহমান।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার পর ষড়যন্ত্রের পাশা খেলা চলছিল। ব্যক্তিগত সোর্স তাজউদ্দিনকে নিয়মিত সেই ষড়যন্ত্রের খবর দিয়ে যাচ্ছে। অথচ তার কথা শোনার মতো সময় নেই শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। ঠিক এমন সময় তাজউদ্দিন আহমদ যেন হাতে চাঁদ পেলেন। কলকাতায় থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্তর। ঢাকায় এসেছেন তিনি। সম্পর্কের খাতিরে তিনি দেখা করলেন তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে। সেই সাক্ষাতে তাজউদ্দিন বিস্ফোরক খবরটি দিলেন।
সুখরঞ্জন দাশগুপ্তর লেখা ‘মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র’ থেকে রোমহর্ষক সেই মুহূর্ত- “পরদিন সকালেই গেলাম তাজউদ্দীনের কাছে। হাতে আমার বিদ্যাসাগর রচনাবলীর একটি খণ্ড। দুই খণ্ড আগেই তাঁকে দিয়েছিলাম। তিনিই আমাকে বিদ্যাসাগর রচনাবলী সংগ্রহ করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এবার তৃতীয় খণ্ড নিয়ে গেলাম। আমাকে দেখেই তাজউদ্দীন বললেন, জরুরি কথা আছে, বসুন। সেখানে উপস্থিত অন্যদের চলে যেতে বললেন। বন্ধ করে দিলেন ভিতর থেকে দরজা। তাঁর কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন হল। বলতে শুরু করলেন, গত চার-পাঁচ মাস আমি ঘর থেকে এক পা’ বেরোইনি। একটা ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে উঠেছে।
আমি জানতে চাইলাম, কীরকম ধরনের ষড়যন্ত্র। তিনি বললেন, কী রকম? হত্যা! হত্যা-ষড়যন্ত্র! আমি শিউরে উঠি। প্রশ্ন করি- কারা এই ষড়যন্ত্র করছে? নাম জানতে পারি? তাজউদ্দীন গম্ভীরভাবে বললেন, কী হবে আর নাম শুনে! তারা সব শেখ সাহেবের বিশ্বস্ত লোক।” (বানান অপরিবর্তিত)
অভিযোগ উঠছিল, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ধংস করছেন শেখ মুজিবুর রহমান। বস্তুত ১৯৭১ পরবর্তী সময়ে তীব্র বিশৃঙ্খল বাংলাদেশে একমাত্র রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে উঠে এসেছিল সশস্ত্র অতি বামপন্থী সংগঠন ‘পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি’। এই দলটির নেতা সিরাজ শিকদার। তিনি গোপনে সরকার বিরোধী সশস্ত্র সংগঠন পরিচালনা করেন। একাধিক রাজনৈতিক হত্যা, ডাকাতির ঘটনায় অভিযুক্ত নকশালপন্থী সিরাজ শিকদার। সর্বহারা পার্টির সাংগঠনিক বিস্তারে শংকিত ছিলেন খোদ মুজিবুর রহমান। তিনি একদলীয় শাসনের জন্য মরিয়া হলেন। নিজের দল আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য সব রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গোপনে ছড়িয়ে পড়ছিল স্বৈরাচারী মুজিব খতম হোক এমন প্রচার। সেনাবাহিনী কিছু অফিসার এই প্রক্রিয়ায় সামিল হলেন। তাদের অভিযোগ, শেখ পরিবারের একচ্ছত্র আধিপত্য চলছে। এর শেষ চাই। সামরিক ছাউনিতে শুরু হল সেনা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা। সূত্র মারফৎ সেই পরিকল্পনার কিছু কিছু পেয়ে যাচ্ছিলেন নিঃসঙ্গ সম্রাট তাজউদ্দিন!
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত লিখেছেন, “ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করা হল। এখন কেবল আমরা দু’জন। তাজউদ্দীন আর আমি। আমি অবাক হয়ে ভাবছি, ব্যাপার কী! ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র। কণ্ঠস্বর নিচে নামিয়ে তাজ বললেন, হ্যাঁ, হত্যা-ষড়যন্ত্র।” (বানান অপরিবর্তিত)
তাজউদ্দিন আহমদও সেই হত্যা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন। ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর হত্যাকারীদের নির্দেশে তাজউদ্দিন আহমদকে গৃহবন্দি করা হয়। পরে তাঁকে পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরে জেলের ভিতরে তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম (অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম রাষ্ট্রপতি) মুহাম্মদ মনসুর আলি এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে গুলি করে খুন করা হয়। এই ঘটনায় বাংলাদেশ তো বটে গোটা বিশ্ব কেঁপে গেছিল।
বাংলাদেশের এই প্রথম সেনা অভ্যুত্থানে জড়িতদের অন্যতম মেজর শরিফুল হক ডালিম। তিনি তাজউদ্দিনের বিশেষ পরিচিত ছিলেন। মেজর ডালিমের জীবনে কলকাতা বিশেষভাবে জড়িয়ে আছে। (ক্রমশ)
গত পর্ব: মুজিব হত্যা ষড়যন্ত্র ২: পার্টি জমতেই ভারতীয় সাংবাদিকের সামনে ক্ষমতা কাড়ার দাবি সেনাকর্তা ডালিমের!