কেন মুজিবুর রহমান খুন? Kolkata 24×7 প্রকাশ করছে সিরিজ। এই সিরিজের মূল লক্ষ্য, মুজিব হত্যার নেপথ্য অংশগুলি দেখা। (The story behind the assassination of Sheikh Mujibur Rahman)
প্রসেনজিৎ চৌধুরী: কমিউনিস্ট রাষ্ট্রপ্রধান ফিদেল কাস্ত্রোকে ঘিরে রেখেছিল যারা, তাদের চেহারা পেশাদার বক্সার-কুস্তিগীর অথবা বডিবিল্ডারদের হিংসার কারণ হবেই। প্রত্যেকের শীতল দৃষ্টি, হাতে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র। দেহরক্ষীদের মাঝে বিশালদেহী (Fidel Castro) ফিদেল কাস্ত্রোই যেন ক্ষীণকায়! তিনি ফুঁকছিলেন বিশ্বখ্যাত হাভানা চুরুট। হাসি হাসি মুখ। কিউবার রাষ্ট্রপ্রধান ফিদেল কাস্ত্রোকে ঠিক কতবার খুনের চেষ্টা করেছিল আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা CIA সেটা সম্ভবত তারা নিজেরাই গুণতে ভুলে গেছে। আমেরিকার নাকের ডগায় কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো মনের সুখে চুরুট টানতেন। তার নিরাপত্তা বলয় ভাঙতে পারেনি সিআইএ। বিশ্বসেরা এই গুপ্তচর সংগঠনটির কাছে কাস্ত্রো হত্যার ফাইল চিরকালের জন্য অসমাপ্ত থেকে গেছে। ফিদেল প্রকৃতির নিয়মে প্রয়াত। তাকে খুন করা যায়নি।
সুকঠিন নিরাপত্তা বলয় নিয়ে কাস্ত্রো যেদিন সামনাসামনি মুজিবুর রহমানকে দেখলেন সেদিনই চিৎকার করে উঠলেন ‘কমরেড মুজিব আপনি জলদি খুন হতে যাচ্ছেন !’ কী আশ্চর্য! ফিদেল যেমনটি বলেছিলেন তেমনই হয়েছিল। গুলি করে শেখ মুজিবুর রহমানকে খুন করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট।এই ঘটনার দু’বছর আগেই মুজিবুর রহমানকেই সরাসরি ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন ‘আপনি খুন হতে যাচ্ছেন’। বহু দূরে কিউবায় যখন মুজিব হত্যার সংবাদ পৌঁছাল তখন কাস্ত্রো হতাশ। তিনিই বিশ্বে প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান যিনি মুজিবুর রহমান খুনের ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন
একজন রাষ্ট্রপ্রধান প্রকাশ্যেই অপর রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা ষড়যন্ত্রের সতর্কবার্তা দিচ্ছেন এমন ঘটনা বিরলতম। তবে ফিদেল কাস্ত্রোর পক্ষেই এই আচরণ করা সম্ভব বলে মনে করেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। কারণ, পছন্দের কাউকে দেখে ফিদেল সহাস্য চিৎকার করতেন। বাংলাদেশের জাতির পিতা মুজিবুর রহমানকে দেখেও চিৎকার করছিলেন ফিদেল!
সেনা অভ্যুত্থানে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে। এই ঘটনায় স্তম্ভিত হয়েছিল বিশ্ব। হামলার সময় জার্মানিতে থাকায় বেঁচে যান মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রক্তাক্ত গণবিক্ষোভে হাসিনা বাংলাদেশ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। এরপর আচমকা প্রকাশ্যে মুজিব হত্যার মূল নকশাকারী মেজর ডালিম হাজির! সামাজিক মাধ্যমে তাকে দেখে স্তম্ভিত বিশ্বের কূটনৈতিক মহল। কারণ মুজিব হত্যার তদন্তে মেজর ডালিম মোস্ট ওয়ান্টেড। দীর্ঘ সময় ধরে সে আত্মগোপনে ছিল।
মেজর শরিফুল হক ডালিম আচমকা আত্মপ্রকাশ ও মুজিব হত্যার প্রসঙ্গ ধরে ফিরে যেতে হবে ১৯৭০ দশকে। গত বিংশ শতকের ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রক্তাক্ত সংঘর্ষের পর বাংলাদেশ গঠিত হয়। নতুন দেশ তৈরির চার বছরের মাথায় বাংলাদেশে হয়েছিল প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান। এমনটা যে হতে চলেছে সে বিষয়ে খোদ মুজিবুর রহমানকেই বলেছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো।
আরও এক রক্তাক্ত ৯/১১ দিন! ফিদেল-মুজিব বৈঠক
১৯৭৩ সালে আফ্রিকার দেশ আলজিরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন চলছে। আর দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলিতে চলছিল সেনা অভ্যুত্থান। ৯ সেপ্টেম্বর চিলির কমিউনিস্ট প্রেসিডেন্ট আলেন্দেকে ঘিরে নিল বিদ্রোহী সেনা। টানা সংঘর্ষ চালিয়ে আলেন্দে মারা গেলেন। তিনিও ফিদেল কাস্ত্রোর বন্ধু ছিলেন। জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে সেই সংবাদ পেলেন কাস্ত্রো। ততক্ষণে সিআইএ তাদের চিলি অপারেশন সফল করেছে। কাস্ত্রোর পক্ষে আর কিছুই করার ছিল না। সেই সম্মেলনেই ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান। কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো একান্তে বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিলেন।
ফিদেল কাস্ত্রো ও বঙ্গবন্ধুর বৈঠকের প্রত্যক্ষদর্শী বিশিষ্ট সাংবাদিক এম আর আখতার মুকুল। তাঁর বই ‘মুজিবের রক্ত লাল’ থেকে সেই বিখ্যাত বৈঠকের আলোচনার অংশটি রইল। (বানান অপরিবর্তিত)
মুজিব : এক্সেলেন্সি আপনি দয়া করে থামবেন না। আপনার কাছ থেকে আরও শুনতে চাই। আমার জ্ঞান চক্ষুর উন্মোচন হচ্ছে।
ক্যাস্ট্রো : অদূরে দণ্ডায়মান দেহরক্ষীদের প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করে বললেন- প্লিজ ত্রাই তু বাই দেম। অফার দেম হানদ্রেদ থাউজেন ডলার-তু। হানদ্রেদ থাউজেন হাফ এ মিলিয়ন। অল রাইট, অফার দেম ওয়ান মিলিয়ন ডলার, নাে ইউ কানত বাই দেম। দিওরিং লং ওয়ার এ্যাগেইনসত ডিকতের বাতিস্তা, উই ফত তুগেদার ফ্রম দ্য সেম বাংকার। উই শেয়ার ফুড-বেড এ্যান্ড এভরিথিং। ইউ কানত ইমাজিন হাউ মাচ দে লাভ মী। আই স্মােক সিগার। মাই বয়েজ তেসত ইত ফাস্ট। তু অফ দেম দায়েইদ। বিকজ সিআইএ পয়জনিং। এক্সেলেন্সি ইন বাংলাদেশ হুম আর ইউ ‘ত্রাসতিং? লাইক কমরেড আলেন্দে, ইউ আর অলছাে গােয়িং টু বি ফিনিশ কমরেড মুজিব.
(দয়া করে এদের কেনার চেষ্টা করুন। এঁদের অফার করুন এক লাখ ডলার-দুলাখ—অর্ধ মিলিয়ন ডলার। আচ্ছা ঠিক আছে, এঁদের এক মিলিয়ন ডলার অফার করুন। না, আপনি কিছুতেই এঁদের কিনতে পারবেন না। ডিক্টেটর বাতিস্তার বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিনের লড়াই-এর সময় আমরা একই বাংকারে থেকে যুদ্ধ করেছি। এ সময় আমরা খাওয়াদাওয়া, বিছানা-সবকিছু একই সঙ্গে ভাগ করেছি। আপনি ধারণাও করতে পারবেন না এরা আমাকে কী পরিমাণ ভালােবাসে। আমার চুরুট খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে। তাই আমার ছেলেরা প্রথমেই প্রতিটি প্যাকেট থেকে চুরুট টেস্ট করে দেখে দুজন তাে মরেই গেল। কারণ সিআইএ-র এজেন্টরা বিষ মিশিয়েছিল। এক্সেলেন্সি, বাংলাদেশে আপনি কাদের বিশ্বাস করেছেন? কমরেড আলেন্দের মতাে আপনিও নিশ্চিহ্ন হতে যাচ্ছেন কমরেড মুজিব।)
“…হাতের অর্ধদগ্ধ চুরুটটা এ্যাশট্রেতে রেখে ধীর পদক্ষেপে ফেলে ক্যাস্ট্রো এগিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। এরপর ক্যাস্ট্রো-মুজিব উষ্ণ আলিঙ্গন আর পরস্পর চুম্বন। আলিঙ্গনের শেষ মুহূর্তে মুজিবের কাধে মাথা রেখে অকস্মাৎ ঘরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে ক্যাস্ট্রো বলে উঠলেন, ‘কমরেড মুজিব, আই লাভ ইউ আই লাভ ইউ। আই লাভ বাংলাদেশ।’ গাড়ি বারান্দার স্টার্ট দিয়ে রাখা বিরাট ‘লিমােজিন’-এ উঠতে যেয়ে হঠাৎ মাথাটা একটু তেরছা করে ঘুরিয়ে ক্যাস্ট্রো চীকার করে স্লোগান দিলেন ‘জয় বাংলা’। আমরা কিছু বােঝার আগেই ঝড়ের বেগে সব কটা গাড়ি বেরিয়ে গেল। …”
আমি হিমালয় দেখিনি, তবে আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি: ফিদেল কাস্ত্রো
১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সের জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ফিদেল কাস্ত্রোর আবেগতাড়িত উপমা-“আমি হিমালয় দেখিনি, তবে আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমতুল্য। আর এভাবেই আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা লাভ করেছি।”
ফিদেল কাস্ত্রোর সতর্কতাবার্তার দু বছরের মধ্যে বাংলাদেশের বিদ্রোহী সেনা কর্তাদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান