Mirzapur: বাবা কেমন আছ? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্তকে প্রণাম করল ফুলন (২)

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: ব্যান্ডিট কুইন ফুলন দেবীর কথা লিখছি না। এমপি ম্যাডাম ফুলন দেবীর কথা লিখছি। গঙ্গার তীরে মির্জাপুর (Mirzapur) শহরে ফুলনের দ্বিতীয় জন্ম হয়েছিল। -বাবা…

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: ব্যান্ডিট কুইন ফুলন দেবীর কথা লিখছি না। এমপি ম্যাডাম ফুলন দেবীর কথা লিখছি। গঙ্গার তীরে মির্জাপুর (Mirzapur) শহরে ফুলনের দ্বিতীয় জন্ম হয়েছিল।

-বাবা কৈসেন হো? প্রণাম।
হকচকিয়ে গেলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত। দেশের প্রথম কমিউনিস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খানিকটা আশীর্বাদের আদলে কন্যা ফুলনের মাথা স্পর্শ করলেন। সংসদের সেন্ট্রাল হলে ততক্ষণে একটি অনবদ্য মুহূর্ত তৈরি হয়ে গেছে।

   

সেন্ট্রাল হল এমনিতেই রঙিন। এখানে যা ঘটে যায় তা একমাত্র সংসদের নিজস্ব। বাইরে তেমন আসে না।  সেন্ট্রাল হলের চরিত্র নিয়ে সাংবাদিক নিমাই ভট্টাচার্য “রাজধানীর নেপথ্যে” বইতে লিখেছেন-‘মাঝে মাঝে মনে হয় বোধকরি সেন্ট্রাল হলই ভারতবর্ষের পার্লামেন্টারী ডেমোক্রাসীর মানস সরোবর।’ এমন মানস সরোবরে সেদিন যেন হাজার সূর্যের ছটা। বাবা কেমন আছ বলে  ইন্দ্রজিত গুপ্তকে ঢিপ করে প্রণাম করেছিল ফুলন দেবী। এই ফুলনের মুখে স্মিত হাসি। সে ঝলমলে শাড়ি পরে আছে। সেন্ট্রাল হলে থাকা অন্যান্য সাংসদদের পারস্পরিক নরকগুলজার থেমে গেল।

বন্দুক ছেড়ে রাজনীতিতে আসা উপমহাদেশের রাজনীতিতে নতুন কিছু ঘটনা নয়। তবে ফূলন তো একজনই। বন্দুক হাতে তার বাগী জীবন যতটা আলোচিত রাজনৈতিক জীবন ততটা চর্চিত নয়।

জাতীয় নির্বাচন ঘিরে দেশজুড়ে চলছিল হইহই কাণ্ড।১৯৯৬ সালের একাদশ লোকসভা গঠন ভারতের সংসদীয় রাজনীতির ঐতিহাসিক মোড়। অযোধ্যায় যে বিতর্কিত কাঠামো ঘিরে ১৯৯২ সালে উন্মত্ত করসেবক আচরণ দেখা গিয়েছিল, তারই জেরে ভারতীয় জনতা পার্টি বিরাট শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। ‘৯৬ সালের  নির্বাচনই বিজেপির ভারত মসনদে বসার প্রথম ধাপ। বৃহত্তম আসন পেলেও পর্যাপ্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় মাত্র তের দিনের মধ্যে পতন হয় অটল বিহারি বাজপেয়ীর নেতৃত্বে চলা সরকার। এবার সরকার গড়ন অ-বিজেপি শক্তি তৃতীয় মোর্চা। সিপিআইএমের কঠোর নির্দেশ মেনে জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হলেন না। তবে দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে গেল সিপিআই। সেই সূত্রে ইন্দ্রজিত গুপ্ত হলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

‘৯৬ সালের লোকসভা নির্বাচনে ছিল চমকের পর চমক। ভোটের গণনা এগিয়েছে, রথী মহারথীর উত্থান-পতনের খবর আসছে। উত্তর প্রদেশ ঘিরেই বিজেপির আসল আশা ভরসা। এখানে বিজেপির প্রধান শত্রু সমাজবাদী পার্টি ও কংগ্রেস। হিন্দি দুনিয়ার হৃদয়স্থল ঘিরে ধুন্ধুমার লড়াইয়ে সমাজবাদী পার্টির প্রধান হিসেবে অ-বিজেপি শক্তির অন্যতম সেনাপতি মুলায়ম সিং যাদব গঙ্গা, যমুনার তীরে তীরে কঠিন প্রতিরোধ গড়ছিলেন। নির্বাচনের এই মহারণভূমিতে উল্কার গতিতে আশ্চর্যজনক আগমণ ফুলন দেবীর। 

মির্জাপুর কেন্দ্র জুড়ে সে এক উত্তেজনাময় চিত্র। এখানে মূল লড়াই হচ্ছিল বিজেপি ও সমাজবাদী পার্টির মধ্যে। গণনা এগিয়েছে নির্দিষ্ট নিয়মে, এদিকে ব্যবধান বাড়ছিল সমাজবাদী প্রার্থী নবাগতা ফুলন দেবীর। পিছিয়ে পড়ছিলেন ঘাঘু নেতা বিজেপির বীরেন্দ্র সিং মালে।  মির্জাপুর শহরের গলি, প্রান্তগলি, গঙ্গার তীর ধরে বিভিন্ন মহল্লা জুড়ে একটাই শব্দ ‘জিত গৈল হমারা ফুলন’!

কে যে কখন ‘দস্যুরানি’ ফুলন দেবীকে ‘হমারা ফুলন’ বানিয়েছিল সেটা জানা সম্ভব না। তবে যেদিন ‘ব্যান্ডিট কুইন’ গাড়ি থেকে নেমে সমাজবাদী পার্টির প্রচার মঞ্চে উঠে হাত জোড় করে বলেছিলেন ‘ম্যায় ফুলন হুঁ…’, সঙ্গে সঙ্গে আকাশ ফাটানো আওয়াজে ‘হমারা ফুলন দেবী কি জয়’ স্লোগান  জনসভা থেকে গঙ্গার স্রোতের মত ছড়িয়ে পড়ে। সেই শব্দই পুরো ভোট পর্বে সমাজবাদী মুখিয়া মুলায়ম সিং কাজে লাগান। ফলাফল চলে গেল ফুলন দেবীর অনুকূলে।  বিজেপির হাত থেকে মির্জাপুর আসন ছিনিয়ে নিল সমাজবাদী পার্টি। 

‘দস্যুরানি’ থেকে ভারতীয় সংসদের মাননীয়া এমপি -অনবদ্য এই যাত্রাপথে ‘আনপড় গাঁওয়ার’ ‘রণ্ডী’ ‘বাগী’ থেকে ‘দেবী’ ফুলন মানেই সত্য-মিথ্যা মেশানো কাহিনীতে ভরপুর জীবন।  জাতিতে নিম্নশ্রেণির ‘মালহা’ (মাঝি)।  নিয়ম করে গণধর্ষিতা হওয়া তাঁর জীবনের খোলা খাতা। কোনওদিনই লুকিয়ে রাখেননি এসব। একটানা ৮ দিন ধরে বেহমই গ্রামে প্রতিদিন তিনবার করে মোট ২৪ বার গণধর্ষণের পর থুথু ফেলে বদলা নেওয়ার তীব্র ইচ্ছে ফুলনকে ত্রাস বানিয়েছিল। চম্বল উপত্যকার ত্রাস।

ফুলন দেবীর জীবনে জড়িয়ে আছে আসল মির্জাপুর। পড়ুুন: Mirzapur:পুলিশের সামনেই চলছিল গুলি…ওয়েব সিরিজ নয় রিয়েল মির্জাপুরের রানি ফুলনদেবী (১)

নব্বই দশকের শেষ পর্বে ভারতের নির্বাচনী মহাযুদ্ধের বিজয়ী নায়িকা হয়েই সংসদ ভবনে পৌঁছলেন মির্জাপুরের এমপি ফুলন দেবী। সংবিধানের শপথ নিয়ে বসলেন নির্দিষ্ট আসনে। উত্তর প্রদেশের  মির্জাপুর থেকে দিল্লি যাত্রার এই সুসময়ে আরও একটি শহর জুড়ে তখন প্রবল শোরগোল। সেই শহরের নাম ভিণ্ড। মধ্যপ্রদেশের এই শহরেই ‘ব্যান্ডিট কুইন’ তার বন্দুক নামিয়েছিল ১৯৮৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। সেই দিন ভিণ্ড শহরে মহারাজ জিওয়াজী রাও সিন্ধিয়া কলেজে মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন সিংয়ের সামনে বাগী জীবনের অধরা প্রতিশোধ চেপে রেখেই ফুলন দেবী আত্মসমর্পণ করল। হাজার হাজার জনতার সামনে মাথায় লাল ফেটি বাঁধা ফুলন হাতজোড় করতেই আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের হটকেক ছবি তৈরি হয়ে যায়। 

সেদিনই চম্বলের অপর ত্রাস মান সিং বন্দুক নামায়। সে বাগী জীবনে ‘দস্যুরানি’র সর্বশেষ মনের মানুষ। দু জনের আত্মসমর্পণের পর ভয়াবহ চম্বল ডাকাত পর্বের শেষ হলো কংগ্রেসের কূটনৈতিক খেলায়। তবে এই খেলায় অর্জুন সিংয়ের কাছে পরাজিত হলেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীপতি মিশ্র।

ফুলন দেবীকে পাকড়াও করতে অর্জুন সিং ও শ্রীপতি মিশ্র দুই কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীর তীব্র কূটনৈতিক লড়াই একেবারে রণংদেহী ভূমিকা নিয়েছিল আশির দশকে। ভয়ঙ্কর বেহড় ঘেঁষে আন্তঃরাজ্য সীমানায় ইউপি-এমপি পুলিশের গুলির লড়াই এমনই এক অভাবনীয় ঘটনা।  যাই হোক ভোটের বাজারে ফুলনকে নিজ পক্ষে টেনে এনে একেবারে শেষ হাসি কিন্তু হাসলেন মুলায়ম সিং যাদব।

মির্জাপুরের এমপি ফুলন যেদিন সংসদ ভবনে কমিউনিস্ট নেতা মেদিনীপুরের এমপি ইন্দ্রজিৎ গুপ্তকে প্রথম দেখলেন সেদিন দুই কিংবদন্তির মোলাকাত দৃশ্য ছিল অনবদ্য। (চলবে)