প্রশান্ত-পন্ডিত যা বলতে চাইছেন

প্রশান্ত কিশোরের (Prashant Kishor) তত্ত্বের সারকথাটি এই রকম। একটি জমানার অবসানের জন্য যে কয়টি পূর্বশর্ত পালিত হওয়া প্রয়োজন, এবার তা অনুপস্থিত। যেমন, এক) আগের দু’টি…

Prashant Kishor

প্রশান্ত কিশোরের (Prashant Kishor) তত্ত্বের সারকথাটি এই রকম। একটি জমানার অবসানের জন্য যে কয়টি পূর্বশর্ত পালিত হওয়া প্রয়োজন, এবার তা অনুপস্থিত। যেমন, এক) আগের দু’টি নির্বাচনের মতো এবার মোদী ম্যাজিক হয়ত সেভাবে কাজ করছেনা, দশ বছর পরে সেটা প্রত্যাশিতও নয়, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আম জনতার ক্ষোভ বা আক্রোশ আছে কী? সেটা যদি না থাকে, ধরে নিতে হবে জমানা বদলের সম্ভাবনা নেই।

দ্বিতীয়ত, বিরোধী শিবিরে এমন কোনও নেতা নেই, আম-জনতা যাঁকে মোদীর বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প হিসাবে ধরে নিতে পারে। এই কাজটি রাতারাতি করা সম্ভব নয়, বিরোধীদের সামনে সে সুযোগ ছিল, তারা তার সদ্ব্যবহার করেনি। মানে ‘টিনা’ ( দেয়ার ইজ নো অলটারনেটিভ) ফ্যাক্টর এবারও নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে। মানুষ ভোটদানের সময় দল বা জোটের চেয়ে নেতৃত্বের প্রশ্নকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়। নেহাত ঠেলায় না পড়লে তারা ‘খিচুড়ি’ সরকার পছন্দ করেনা।

   

তৃতীয়ত, উত্তর ও পশ্চিম ভারতে বিজেপি যদি কয়েকটি আসন হারায় তার ক্ষতিপূরণ হয়ে যাবে দক্ষিণ ও পূর্বভারতে চমকপ্রদ সাফল্য দিয়ে। তেলেঙ্গানা, কেরল, তামিলনাড়ুতে বিজেপির আসন সংখ্যা ও প্রাপ্ত ভোট দু’টোই উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে। পূর্ব ভারতে পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশাতেও বিজেপি ২০১৯-এর তুলনায় বেশি আসন জিতবে। হরে দরে তার মানে বিজেপির মোট প্রাপ্ত আসন কমার কোনও সম্ভাবনা নেই বরং সামান্য হলেও বাড়বে।

গোড়াতেই বলেছি, প্রশান্ত-পন্ডিত অবান্তর প্রলাপ বকেননা, তাঁর বক্তব্যে তথ্য ততটা না থাকলেও শানিত যুক্তি অবশ্যই থাকে। সেই স্বীকৃতির প্রেক্ষাপটে এবার তাঁর তোলা প্রসঙ্গের মূল্যায়ন করা যাক।

প্রথমেই ভোটারের গুস্সার কিসসা। ১৯৫২ থেকে ২০২৪ এদেশের সংসদীয় নির্বাচনের ইতিহাস একটু মন দিয়ে বিবেচনা করলেই আপনি যে কোনও তত্ত্বের সমর্থনে অথবা বিরোধিতায় পূর্ব-নজির ঠিক খুঁজে পাবেন। মানুষের ক্ষোভের কারণে দিল্লির তখত বদল হওয়ার অজস্র উদাহরণ আছে। ইন্দিরা জমানায় দু’বার, রাজীবের জমানায় একবার এবং নরেন্দ্র মোদীর জমানাতেও একবার। ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্রোধ যদি ইন্দিরা গান্ধিকে ক্ষমতাচ্যুত করে থাকে তাহলে মাত্র তিন বছর পরে আবার সেই জনতাই তাঁকে বিপুলভাবে ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনেছিল জনতা সরকারের কুশীলবদের সার্বিক অপদার্থতা এবং নিজেদের মধ্যে অনবরত খেয়োখেয়িতে বিরক্ত হয়ে। ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধিকে হারিয়ে দিয়েছিল বফর্স কেলেঙ্কারি ও তজ্জনিত জনতার রোষ।

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী গান্ধিনগর থেকে উড়ে এসে দিল্লি কব্জা করতে পেরেছিলেন মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় ইউ পি এ সরকারের অকর্মন্যতা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণরোষের পিঠে চেপে। এই হিসাবের মধ্যে সচেতনভাবেই আমি ১৯৮৪-র লোকসভা ভোটকে রাখছিনা কেননা সেটা ছিল সর্বার্থে একটি অস্বাভাবিক নির্বাচন। নিজের দেহরক্ষীদের হাতে ইন্দিরা গান্ধির মৃত্যু গোটা দেশকে এমনভাবে আন্দোলিত করেছিল যে রাজীব তাঁর মাতামহের রেকর্ডকে ম্লান করে দিয়ে সর্বকালের সেরা রেকর্ড গড়েছিলেন সোজা ৪১৩টি আসন জিতে গিয়ে। বাকি সব ভোটের হিসেব-নিকেশ এই নির্বাচনে তার প্রাপ্য গুরুত্ব খুইয়েছিল, এমনটি যে হতে পারে, বাস্তবে হওয়া সম্ভব, কেউ তা কল্পনাও করতে পারেনি।

অতএব জমানা বদল হওয়ার সঙ্গে জনতা-জনার্দনের ক্ষোভ অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পৃক্ত, প্রশান্ত পন্ডিতের এই যুক্তি একেবারেই অসার নয়।

ঠিক যেমন একজন প্রবল ক্ষমতাশালী, জনমনহরণে সক্ষম প্রধানমন্ত্রীকে গদিচ্যুত করতে বিরোধী শিবিরে একটি সমান, ক্ষেত্র বিশেষে অধিকতর যোগ্য মুখের প্রয়োজন হয়, একথাও অনস্বীকার্য। তার অর্থ মানুষের ক্ষোভ থাকতে হবে, তাকে শাসক বিরোধিতায় রূপান্তরিত করার জন্য একজন নেতারও প্রয়োজন। ১৯৭৭ সালে সেই প্রয়োজন পূরণ করেছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ন, ১৯৮৯ সালে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী। প্রশান্তর প্রশ্ন তথাকথিত ইন্ডিয়া জোটে সমতুল কোনও নেতাকে দৃশ্যমান দেখা যাচ্ছে কী?

জয়প্রকাশ তাঁর স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে বেরিয়ে এসে ইন্দিরা গান্ধির বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত না নিলে ৭৭-এর ইতিহাস তৈরি হোতনা। জয়প্রকাশ ছিলেন নেহরু ও তাঁর পত্নী কমলার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত বন্ধু, উচ্চতায় অথবা বিশ্বাসযোগ্যতায় তাঁর সামনে ইন্দিরা ছিলেন নেহাতই পিগমি। তিনি দীর্ঘকাল সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন, তাঁর অবস্থান ছিল ক্ষমতার লোভ-লালসার অনেক উর্ধ্বে। একইভাবে রাজীব গান্ধির বিরুদ্ধে বিশ্বনাথ প্রতাপের প্রধান পুঁজি ছিল প্রশ্নাতীত ব্যক্তিগত সততা। রাজা হয়েও তিনি ফকিরের বেশে ঘুরতেন যেটা জনতার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছিল।

সবশেষে ২০১৪ সালে মোদীর পুঁজি ছিল টানা পনেরো বছর ধরে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রিত্ব আর তাঁর বহু উচ্চারিত উন্নয়নের গুজরাত মডেল। তাঁর সততা, নিষ্ঠা কিংবা ব্যক্তিগত জৌলুস সত্ত্বেও মনমোহন সিংকে কেমন যেন ম্লান দেখিয়েছিল তাঁর অপরিচিত, দিল্লির রাজনীতিতে নবাগত, এক গুজরাতি প্রতিদ্বন্দ্বীর সামনে। আজ মোদী বিরোধী শিবিরে সত্যিই তেমন কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই যিনি জনতার ধূমায়িত ক্ষোভে ভাষা দিয়ে ভোটে রূপান্তরিত করতে পারেন। একজন অবশ্য আছেন। রাহুল গান্ধি। তিনি কানার মধ্যে ঝাপসা নিঃসন্দেহে। তবু তিনি কী এত চেষ্টা করেও মোদীর বিকল্প হয়ে উঠতে পারলেন? আলোচনা করব আগামী কাল। (চলবে)