রাহুলের উন্নতি, পাপ্পু থেকে শাহজাদা

ছিলেন ‘পাপ্পু’ হলেন ‘শাহজাদা’। কেউ কেউ আগে ‘রাহুল বাবা’ (Rahul Gandhi) নামে উপহাস করতেন, এখন আর করেন না। বিরোধীদের মূল্যায়নে এত দিন পরে, রাহুল গান্ধির…

Suman Chattopadhyay Analyzes the Political Rise of Congress Leader Rahul Gandhi

ছিলেন ‘পাপ্পু’ হলেন ‘শাহজাদা’। কেউ কেউ আগে ‘রাহুল বাবা’ (Rahul Gandhi) নামে উপহাস করতেন, এখন আর করেন না। বিরোধীদের মূল্যায়নে এত দিন পরে, রাহুল গান্ধির এইটুকু পদোন্নতি অথবা সম্মানপ্রাপ্তি ঘটেছে অবশ্যই। কিন্তু এটা অবশ্যই যথেষ্ট নয়। রাহুল সক্রিয় রাজনীতি করছেন, তাও নয় নয় করে পনেরো বছর তো হবেই। আগের চেয়ে তিনি এখন অনেক পরিণত, কথায় কথায় বিদেশে পালিয়ে যান না, দুটি দফার ভারত জোড়ো যাত্রা করে দেশটাকে চিনেছেন, তাঁকেও দেশের মানুষ চিনেছে। কংগ্রেস সংগঠনে দীর্ঘদিন তাঁর নেতৃত্ব স্বীকৃত ছিল স্রেফ বংশগত কারণে, এখন তার পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে অভিজ্ঞতা, কতকটা নৈতিক কর্তৃত্বও।আগের তুলনায় এখন তিনি সংসদের ভিতরে বাইরে কথায় বার্তায় অনেক সড়গড়, আম পাবলিকের কাছের মানুষ।

তবু বলব, জনসভায় বক্তা হিসেবে রাহুলের তুলনায় প্রিয়ঙ্কা অনেক বেশি তীক্ষ্ন, যুক্তি-তথ্য-পরিমিত আগ্রাসন- রসবোধ মিলিয়ে মিশিয়ে তিনি যেভাবে জনতার হৃদয় ছুঁতে পারেন, রাহুল অদ্যাবধি তা পারেন না। আমার মতে ২০২৪-এর সেরা আবিষ্কার অবশ্যই প্রিয়ঙ্কা, যদিও তিনি নিজে ভোটে লড়েননি, সারা দেশ ঘুরে ঘুরে কংগ্রেসের হয়ে প্রচার করেছেন আর ‘ভাইয়ার’ কেন্দ্র রায়বেরিলির পাহারাদারি করেছেন। ভোটের পরে দুটি কেন্দ্র থেকেই বিজয়ী হতে পারলে রাহুল এবার কেরলের আসনটি সম্ভবত ছেড়ে দেবেন, তাঁর সহোদরা সেই শূন্যস্থান পূরণ করবেন কিনা তা অবশ্য পরিষ্কার নয়।

   

নয়রাহুল প্রকৃতিতে নরম, সুভদ্র, বিনম্র, হাসিমুখের মানুষ। ইন্ডিয়া জোটের বাকি নেতাদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক আছে, বিশেষ করে তাঁরই প্রজন্মের নেতা সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদব, তেজস্বী যাদব মায় শিবসেনার উদ্ভব ঠাকরের সঙ্গেও। ব্যতিক্রম একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁর সঙ্গে রাহুলের পারস্পরিক বিশ্বাস আর নির্ভরতার সম্পর্ক একেবারেই গড়ে ওঠেনি। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বের ধারার সঙ্গে এখানেই রাহুলের বড় পার্থক্য চোখে পড়ে। কপাল ফেরে বিজেপি যদি এবার একক গরিষ্ঠতা না পায়, কোয়ালিশন সরকার গডতে বাধ্য হয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদী তখন কতটা সফল হবেন বলা কঠিন। কেননা পূর্বজ অটল বিহারী বাজপেয়ীর মতো তিনি ‘কনসেন্সাস ম্যান’ নন, দল ও সরকারের ওপর নিরঙ্কুশ, একচ্ছত্র কর্তৃত্বে না থাকলে মোদী কতটা স্বস্তিতে থাকবেন বলা যায়না।মোদী অথবা মমতার নেতৃত্বের মূল কথাটা হোল, ‘মাই ওয়ে অর হাইওয়ে’, হয় আমার মতের সঙ্গে তাল মেলাও নয়তো তফাত যাও।

তুলনায় রাহুলের নেতৃত্ব মেনে নিতে এক মমতা ছাড়া বিরোধী জোটের বাকি শরিকদের খুব একটা অসুবিধে হবে বলে মনে হয়না। আবার মমতা বাদে অন্য কেউ যদি সর্বসম্মতভাবে নির্বাচিত হন, রাহুলের আপত্তি থাকবে বলে মনে হয়না। যদিও দু’টি সম্ভাবনাই আপাতত অনিশ্চয়তার গর্ভে সুপ্ত। এ পর্যন্ত ঠিকই আছে।

কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর বিকল্প গ্রহনযোগ্য মুখ হওয়ার পক্ষে এ সবই অপ্রতুল। ভোটের সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতানৈক্য থাকলেও একটি বিষয়ে তাঁরা সবাই একমত। মোদীর জনপ্রিয়তার ধারে কাছে আসতে পারেন, এদেশে এই মুহূর্তে দ্বিতীয় কোনও নেতা নেই। পশ্চিমী সমীক্ষকদের একাংশতো বছর বছর ঘোষণা করেন মোদী কেবল নিজের দেশে নয় গোটা দুনিয়ার সব দেশের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। অতএব প্রশান্ত পন্ডিত যদি তাঁর হিসেব নিকেশে নেতৃত্বের প্রশ্নটিকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, বড় একটা ভুল করেননি।

প্রশান্তর তৃতীয় উপপাদ্য, অর্থাৎ পূবে-দক্ষিণে বিজেপি এবার অপ্রত্যাশিত ভালো ফল করবে এবং তার ফলে উত্তর-পশ্চিমে সামান্য ঘাটতি হলেও তা পুষিয়ে পূর্বাবস্থায় চলে আসবে এটি নিছকই লাগে তাক না লাগে তুক জাতীয় বিশ্লেষণ। বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণের পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে কর্ণাটকে বিজেপির সংগঠন পাকাপোক্ত আর তেলেঙ্গানায় তারা উদীয়মান শক্তি। এছাড়া কেরল, তামিলনাড়ু অথবা অন্ধ্রপ্রদেশে বিজেপি অদ্যাবধি ঠুঁটো জগন্নাথ, কোথাও তারা অতীতে একটি লোকসভার আসনও জিততে পারেনি।

কেরল এবং তামিলনাড়ুতে নিজেদের পক্ষে হাওয়া তোলার জন্য বিজেপি প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছে,প্রধানমন্ত্রী ঘনঘন এই দুই রাজ্য সফর করেছেন, যস্মিন দেশে যদাচারের নিয়ম মেনে ভক্ত বেশে মন্দিরে মন্দিরে মাথা ঠেকিয়েছেন, তবু চিঁড়ে কতটা ভিজবে বলা দুষ্কর।অন্ধ্রপ্রদেশে বিজেপি এবার চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলুগু দেশম পার্টির সঙ্গে জোট গড়ে ভোটে যাওয়ায় এবার সেখানে দলের খাতা খুললেও খুলতে পারে, জগন রেড্ডির গদিচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায়না। কিন্তু মাথা-ভর্তি টাকে দু’চার গাছা চুল গজালে কী মাথা কালো দেখায়? এই যতসামান্য লাভের গুড় পিঁপড়েয় খেয়ে যাবে অন্যত্র। কর্ণাটকেই।

গত লোকসভায় এই রাজ্যের ২৬টি আসনের মধ্যে বিজেপি পঁচিশটিই নিজেদের দখলে রেখেছিল, তাদের স্ট্রাইক রেট ছিল প্রায় নিরানব্বই শতাংশ। এবার খুব ভাল ফল করলেও বিজেপি কর্ণাটকে ১৫টির বেশি আসনে জিতবে না, অনেকের হিসেবে আরও কমে গেলেও আশ্চর্যের কিছুই থাকবেনা। কর্ণাটকের একটি রাজ্যস্তরের সমীক্ষক সংস্থা (এরা বিধানসভায় ফলাফলের অঙ্ক অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে দিয়ে সুনাম কুড়িয়েছিল) তো বুক ঠুকে ভবিষ্যদ্বানী করেছে এবার কর্ণাটকের লোকসভা ভোটে নাকি উল্টোরথ সম্পূর্ণ হবে। মানে বাইশটি আসন খোয়াবে বিজেপি। আশায় বাঁচে চাষা, দেখা যাক।
বাকি রইল উৎকল-বঙ্গের কথা। কড়ির ঝাঁপি খুলব কাল।  (চলবে)