মূর্খ পন্ডিতের ভোট আখ্যান

আমি প্রশান্ত কিংবা যোগেন্দ্র ভায়াদের মতো পন্ডিত নই, যদিও সেই ১৯৮৪ সাল থেকে ভোট (Lok Sabha Elections) দেখার আর কভার করার দু’কড়ির অভিজ্ঞতা আছে আমার…

Lok Sabha Elections, Suman Chattopadhyay

আমি প্রশান্ত কিংবা যোগেন্দ্র ভায়াদের মতো পন্ডিত নই, যদিও সেই ১৯৮৪ সাল থেকে ভোট (Lok Sabha Elections) দেখার আর কভার করার দু’কড়ির অভিজ্ঞতা আছে আমার ঝুলিতে। মূর্খ হলেও ভোটের ফলাফল নিয়ে বাজি ধরার মতো মহামূর্খ আমি নই, আমার সে সাধ অথবা সাধ্য কোনওটাই নেই। আমি কেবল আমার কতক কম্পিত ধারণার কথা নিবেদন করতে পারি মাত্র। ধান না ভেঙে সেই শিবের গীত শোনাচ্ছি যৎপরোনাস্তি সংক্ষেপে।

এদেশের গত দুটি নির্বাচনের মতো এবার সমগ্র ভারত জুড়ে ভোটার-চিত্ত উদ্বেলিত করার মতো কোনও ঘটনা, দুর্ঘটনা অথবা ইস্যু ছিল না। ২০১৪তে ছিল ইউ পি এ সরকারের সার্বিক ব্যর্থতা, অকর্মণ্যতা, পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি নিয়ে জনতা জনার্দনের তীব্র ক্ষোভ। সেই ক্ষোভের ঢেউয়ে সওয়ার হয়ে হঠাৎ পরিত্রাতার ভূমিকায় গান্ধিনগর থেকে দিল্লির মাটিতে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী আবির্ভূত হয়েছিলেন, মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করেছিল। পাঁচ বছর পরে ঠিক ভোটের মুখে কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ঘটে গেল মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি, প্রত্যাঘাত হোল বালাকোটে। ফলস্বরূপ একদিকে স্বদেশ প্রেমের উদ্বেলতা আর অন্যদিকে প্রত্যাঘাত-জনিত বুক ঠোকার যুগ্ম আবেগ গ্রাস করল গোটা দেশটাকে। ভোট যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই বিজেপি-বিরোধী শিবির অস্ত্র সংবরণ করতে বাধ্য হল। ভারতবাসী ফের বিশ্বাস করল, “মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়।’

   

এবার তৃতীয়বারে বিজেপির ভাগ্যে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা জোটেনি। জানুয়ারিতে গোটা দেশে ‘ম্যানুফ্যাকচারড’ ভক্তির পরিকল্পিত প্লাবন ঘটিয়ে যখন অযোধ্যার অসমাপ্ত মন্দিরে, শঙ্করাচার্যদের বিরুদ্ধ মত উপেক্ষা করে নরেন্দ্র মোদী যজমানের বেশে রামলালার নতুন বিগ্রহের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলেন দেশ জুড়ে ভক্ত হিন্দুদের মনে ভক্তির হিল্লোল লক্ষ্য করা গিয়েছিল। বিজেপি নেতৃত্বও সম্ভবত আশা করেছিলেন হয়ত এবারের ভোটে এই রামমন্দিরই হবে বালাকোটের বিকল্প, রাম-নাম জপে ফের দিল্লি তাঁদের কব্জায় এসে যাবে। এলনা।

রাম মন্দিরের স্থান পুনরুদ্ধার করার আন্দোলনে দীর্ঘকাল ধরে যে আবেগকে ধরে রাখা সম্ভব হয়েছিল, একবার উদ্দেশ্য চরিতার্থ হয়ে যাওয়ার পরে স্বাভাবিক নিয়মেই আবেগ স্থায়ী হয়নি। ভোটরঙ্গ শুরু হওয়ার পরেই বিজেপি সেটা উপলব্ধি করে প্রচারের স্রোত অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়। তখন আর বিকল্প খোঁজার সময় ছিলনা, অন্ধকারে হাতড়েও কোনও লাভ হোতনা। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল অযোধ্যার এই সুরম্য মন্দির যে লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সেখানেও বিজেপি প্রার্থী কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গিয়েছেন। ৪ জুন বিকেল হওয়ার আগেই স্পষ্ট হয়ে যাবে রামচন্দ্র প্রতিবেশীর প্রতি কতটা সদয় হলেন বা আদৌ হলেন কিনা!

তবু বিজেপির শিবিরে এমন একটি ব্রহ্মাস্ত্র ছিল যা বিরোধীদের ছিল না, অদূর ভবিষ্যতে থাকার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। নরেন্দ্র মোদী, জনপ্রিয়তার নিরিখে ভারতীয় রাজনীতিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, আন্তর্জাতিক নেতাদের মধ্যেও জনপ্রিয়তম। ইন্দিরা গান্ধির পরে এদেশে এমন জনমনহরণশক্তি সম্পন্ন নেতা ভারতে আসেনি। মোদী বিজেপির তুরুপের তাস, এবার দলের প্রচার সহ বাকি সবকিছু ছিল ব্যক্তি মোদী-কেন্দ্রিক। গত দুটি নির্বাচনেও ছিল, তবে এবার তা অতীতের রেকর্ডকেও সম্পূর্ণ ম্লান করে দিয়েছে। বিজেপির কাছে তিনিই পিতা, তিনিই স্বর্গ, তিনিই ধর্ম, তিনিই আরাধ্য, সব মুশকিলের এক এবং অদ্বিতীয় আসান।

এবারের ভোটের প্রচারে ‘কমল কা ফুল’-এর উচ্চারণ ছাড়া বি জে পি অথবা এন ডি এ-র নামগন্ধটুকু ছিলনা। ভোটারদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি কোনওটাই বি জে পি অথবা এন ডি এ-র নয়, পুরোটাই ‘মোদী কি গ্যারান্টি।’ নির্বাচনী সভা, মিডিয়ায় কোটালের বানের মতো বিজ্ঞাপন, সর্বত্রই এক থেকে একশ শুধুই মোদী, মোদী, মোদী। এবারে তাপক্লিষ্ট ক্লান্তিকর দেড় মাস ব্যাপী ভোটের প্রচারে মোদীর নাম যতবার উচ্চারিত হয়েছে ভগবান রামের নামও ভক্তজন ততবার আওড়েছেন কিনা সন্দেহ!

এমন ব্যক্তি-সর্বস্ব রাজনীতি বিজেপিতে আমদানি করেছেন মোদী স্বয়ং। আমার মতে এটা বাঘের পিঠে চড়ে থাকা রাজনীতি যা অনেকটা কংগ্রেসি ঘরানার রাজনীতির কপি-পেস্ট, বিজেপির মতো দলে সত্যিই অভিনব। মোদীর আবির্ভাবের আগে বিজেপি দল যেভাবে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে পরিচালিত হোত কিংবা তখন রাজ্যস্তরের প্রধান নেতারা দলে যতটা গুরুত্ব পেতেন নতুন জমানায় সেই ঐতিহ্য প্রায় সম্পূর্ণ অস্তমিত। ইন্দিরা গান্ধিও সম্ভবত দলে ও প্রশাসনে ক্ষমতা এতটা নিরঙ্কুশভাবে নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করেননি বা করতে পারেননি। বিজেপি অথবা এনডিএ সব কিছুই আদতে প্রহেলিকা, দিল্লির শাসনের অর্থ আজ সব অর্থে মোদীর শাসন, দল অথবা সরকার অথবা জোট সব কিছু তাঁরই আলোর ছটায় উদ্ভাসিত।

এমন অবিশ্বাস্য, অভূতপূর্ব রূপান্তর অকারণে হয়নি।একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায় এমন সর্বাধিনায়কের সাফল্যের উৎসে আছে নির্বাচনী সাফল্য। বিজেপি কখনও লোকসভায় একক গরিষ্ঠতা পেতে পারে মোদীর দিল্লি প্রবেশের আগে তা অকল্পনীয় ছিল। অটল বিহারী বাজপেয়ী অথবা লাল কৃষ্ণ আডবাণীর জমানার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর জমানার প্রধান পার্থক্য এইখানেই। মোদীই প্রথম সেই আপাত-অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখালেন ২০১৪-র লোকসভা ভোটে। পরের ভোটে সেই ধারা অব্যাহত রেখে তাঁর নেতৃত্বে বিজেপির জেতা আসন সংখ্যা তিনশ ছাড়িয়ে গেল। এই সাফল্যের ভিতের ওপরে তৈরি বিজেপির নয়া জমানা, তাদের নতুন অবতার। বীরভোগ্যা বসুন্ধনায় বিজয়ীর পদতলে সবাই সমর্পিত হয়, এমনকী দলের অন্দরের বিবাগীরাও। সংসদীয় গণতন্ত্রের চরিত্র লক্ষণ হোল ‘জো জিতা ওহি সিকান্দর’।

কিন্তু এই সাফল্যের অভ্যস্ত ধারায় যদি ছেদ পড়ে তখন? কিংবা এবারের নির্বাচনেই কী তেমন অঘটন ঘটার কোনও সম্ভাবনা আছে?

জন্ম যদি তব বঙ্গে তিষ্ঠ ক্ষণকাল। (চলবে)