আজ ১১ সেপ্টেম্বর। আজকের এই দিন একটি বিশেষদিন হিসেবে অতীতেও আলোচিত হয়েছে। আজও সমান ভাবে হচ্ছে (Bengalis Denied Respect)এবং সুদূর ভবিষ্যতেও যে হবেই তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। আজকের রাজনৈতিক ভাষা আন্দোলনের শরিকদের বিশেষভাবে এই দিনটা মনে রাখা প্রয়োজন বলে মনে করি।
১৮৯৩ সালের আজকের দিনে মানবতার আইকন এবং বাংলার এক ক্ষণজন্মা পুরুষ আমেরিকার শিকাগো শহরে গিয়ে এমন এক বক্তৃতা দিয়েছিলেন, যে শান্তির বাণী শুনে শুধু মার্কিনরাই নয় মাথা নুইয়ে কুর্নিশ জানিয়েছিল সারা বিশ্ব।
বলাই বাহুল্য সেই ক্ষণজন্মা পুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ। সাত দিন ধরে বিভিন্ন বিষয়ের উপর বক্তৃতা দিয়েছিলেন স্বামীজী যার ব্যাখ্যা করা আমাদের মত অর্ধ শিক্ষিতের কাছে অনধিকার চর্চা। সবচেয়ে আশ্চর্য তার আগে অব্দি এই মহান বাঙালিকে শুনতে হয়েছে কটুকথা এবং বিভিন্ন ধরণের কুরুচিকর বিদ্রুপ। আজকে সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই প্রথম যে কথাটা শোনা যায় বা চাক্ষুস করা যায় তা হল ট্রোলিং এবং রোস্টিং।
বাঙালি যে এই দুটি শব্দে প্রাচীনকাল থেকেই পারদর্শী তা সামান্য পড়াশুনো করলেই বোঝা যায়। সন্ন্যাস জীবন শুরুর আগে এবং পরে এই বাংলার বাঙালিরাই স্বামী বিবেকানন্দ এবং অন্যান্য সন্ন্যাসীদের শুধুই বিদ্রুপ করেছেন। এই বাঙালিদের কাছে ভিক্ষের ঝুলি বাড়িয়ে দিলেও বেশিরভাগ বঙ্গসন্তানদের কাছ থেকে তারা পেয়েছেন শুধুই লাঞ্ছনা।
এ হেন স্বামীজী যিনি সঠিক বুঝতে পেরেছিলেন আমাদের বাঙালিদের সমস্যা মেরুদণ্ডে। কেন আমাদের বেদ পাঠ অপেক্ষা ফুটবল বেশি খেলতে হবে? আর তাকেই কিনা বিদ্রুপ করে বাঙালি বানাল ‘বিবি কা আনন্দ।’ বাংলা সহ ভারতবর্ষে তখন চলছে ইংরেজদের অকথ্য অত্যাচার। বেদান্ত এবং স্পিরিচুয়ালিজম পথের এই অনন্য পুরুষ এবং ভারত তথা বিশ্বের এক অন্যতম দার্শনিক নিজের বুক দেখিয়ে বললেন বাঙালি সন্তানদের বিরুদ্ধে যদি একটাও গুলি চলে তাহলে সেই গুলি যেন এই বুকে এসে লাগে।
এই মানবতার প্রতিমূর্তি বাঙালি সন্তানকে আমেরিকা পাঠানোর জন্য এগিয়ে আসেননি তৎকালীন কলকাতার কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। কলকাতায় সেই সময় তাবড় তাবড় প্রভাব প্রতিপত্তি সম্পন্ন মানুষ। কলকাতায় তখনও প্রভাবশালী, শোভাবাজারের দেব পরিবার। যাদের বাড়ির দূর্গাপুজো দেখতে বাঙালি আজও লালায়িত হয়ে যায়। এগিয়ে এসে কোনোরকম অর্থকরী সাহায্য করেননি।
আসলে স্বামীজী এই ধর্ম মহাসভার কথা জানতে পারেন ১৮৯২ সালে। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও যে যাবার উপায় নেই। অর্থ কোথায়? তৎকালীন কলকাতার কোনও বাবু ই যে এগিয়ে আসেনি তাকে অর্থকরী সাহায্য করার জন্য। তবে সাহায্য এল। সাহায্য এল সুদূর দাক্ষিণাত্য থেকে। অধুনা মাদ্রাজ এবং এখনকার চেন্নাইয়ের স্বামীজীর এক ভক্ত পেরুমল জেদ ধরলেন তার আদর্শ স্বামিজীকেই আমেরিকার এই ধর্ম মহাসভায় পাঠাতে হবে।
যদি ভারতের হয়ে কেউ সেখানে প্রতিনিধিত্ত্ব করেন তাহলে তিনি হবেন স্বামীজী। অবশ্য সকলের অবগতির জন্য জানিয়ে রাখা ভালো এই ধর্ম মহাসভায় আরও এক বঙ্গ সন্তান তৎকালীন বিখ্যাত বাগ্মী কেশব চন্দ্র সেনও যোগ দিয়েছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন স্বামীজীর প্রতিপক্ষ হিসেবে। অবশ্য স্বামীজীর সাবলীল বাগ্মিতা এবং পান্ডিত্যের কাছে কেশব চন্দ্রের বক্তৃতা দাগ কাটতে পারেনি।
আশ্চর্য ঘটনা ঘটল আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পর। হাওড়া স্টেশনে স্বামীজী নামতেই বাঙালির উত্তেজনা তুঙ্গে। যে মানুষটা এতদিন খালি পায়ে এই কলকাতা চষে বেড়িয়েছেন, অসময়ে কেউ তার দিকে বাড়িয়ে দেয়নি সাহায্যের হাত, কিন্তু আজ তিনি হঠাৎ করেই যুব সমাজের আইকন। তার কারণ বাঙালিরা হতচ্ছেদ্দা করলেও তাকে মান দিয়েছে সাহেবরা। সুতরাং এবার আর বাঙালির পাল্টি খেতে কোনও অসুবিধা নেই।
শুধু কি তাই বাঙালি যুবকদের একটি দল ঘোড়ার গাড়ির ঘোড়া খুলে দিয়ে নিজেরাই টেনে নিয়ে এল স্বামীজিকে। স্বামীজী হয়তো মনে মনে হেসেছিলেন। কিন্তু জবাব দিয়েছিলেন তার ই সমসাময়িক আরেক কৃতি বঙ্গ সন্তান রবীন্দ্রনাথ।
১৯১৩ সালে নোবেল পেয়ে কলকাতায় তাকে যে ভাবে সম্মান করেছিল বাঙালি তা দেখে তিনি বলেছিলেন “গীতাঞ্জলী তো আগেই লিখেছিলাম, দাম পেল বিদেশিরা পুরস্কার দেওয়ার পরে।” এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়াই যায়।
Government Schemes 2025: সাধারণ মানুষের জন্য নয়া সুবিধা ও পরিবর্তন
বিদ্যাসাগর থেকে স্বামীজী। রবীন্দ্রনাথ থেকে সত্যজিৎ বাংলার এই গর্বরা একটা সময় বাংলার বুকে উপেক্ষিত হয়েছেন বাঙালিদের কাছেই। আজ যখন এই মনীষীরা, এই কৃতি বঙ্গ সন্তানেরা রাজনীতির ক্ষুদ্র স্বার্থে ব্যবহৃত হন তখন সত্যি মনেহয় অবাঙালির প্রয়োজন নেই, বাঙালিকে অসম্মান করার জন্য বাঙালিরাই যথেষ্ট।