Gold Price Prediction: সোনা, ভারতীয়দের কাছে শুধু একটি মূল্যবান ধাতু নয়, বরং এটি ঐতিহ্য, সমৃদ্ধি এবং আর্থিক নিরাপত্তার প্রতীক। অক্ষয় তৃতীয়া, ধনতেরাস কিংবা দীপাবলির মতো উৎসবগুলিতে সোনার ক্রয়-বিক্রয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। সম্প্রতি, মাল্টি কমোডিটি এক্সচেঞ্জে (এমসিএক্স) সোনার দাম প্রতি ১০ গ্রামে ৯৯,৩৫৮ টাকার রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে, যা ৭৭,০৭৮ টাকার নিম্ন স্তর থেকে ২২.৪২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা সত্ত্বেও, বিশ্লেষকরা সোনার দাম নিয়ে আশাবাদী, তবে বিনিয়োগকারীদের জন্য কিছু সতর্কতাও জারি করেছেন। প্রশ্ন উঠছে, ২০২৫ সালের মে মাসে অক্ষয় তৃতীয়ার (৩০ এপ্রিল) পরে সোনায় বিনিয়োগ করা উচিত, নাকি দামে সংশোধনের জন্য অপেক্ষা করা বুদ্ধিমানের কাজ? আসুন বিশ্লেষকদের মতামত এবং বাজারের গতিবিধি বিশ্লেষণ করি।
সোনার দামে উত্থানের কারণ
এঞ্জেল ওয়ান-এর কমোডিটি বিশ্লেষক তেজস অনিল শিগ্রেকরের মতে, সোনার দাম বৃদ্ধির পিছনে ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা, পারস্পরিক শুল্ক নীতি এবং মার্কিন ডলারের শক্তিশালী অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতির পরিবর্তনের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে উত্তেজনা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে, যা সোনার দামে সাময়িক সংশোধনের কারণ হয়েছে। তবে, এই সংশোধন সত্ত্বেও সোনার দীর্ঘমেয়াদী সম্ভাবনা ইতিবাচক রয়েছে। সম্প্রতি, সোনার জুন ফিউচার মূল্য এক সপ্তাহে ৬.৮১ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ৩,৫০৯.৯ ডলার প্রতি আউন্স (৯৯,৩৫৮ টাকা প্রতি ১০ গ্রাম) থেকে কমেছে। একইভাবে, রুপোর স্পট মূল্য ১.৭৭ শতাংশ কমে ৩২.৯০ ডলার প্রতি আউন্সে নেমেছে। তবে, উভয় ধাতুই টানা তৃতীয় সপ্তাহের জন্য লাভের পথে রয়েছে, যা বাজারের শক্তিশালী ভিত্তি নির্দেশ করে।
সোনা-রুপোর অনুপাত: কী বোঝায়?
শিগ্রেকর আরও উল্লেখ করেছেন যে বর্তমানে সোনা-রুপোর অনুপাত ১:৮৫-এ রয়েছে, যা আগামী মাসগুলিতে ১১৫-এর পূর্ববর্তী উচ্চতা অতিক্রম করতে পারে। এই অনুপাতটি এক আউন্স সোনার মূল্যের জন্য কত আউন্স রুপো প্রয়োজন তা নির্দেশ করে। উদাহরণস্বরূপ, ১:৮৫ অনুপাত মানে এক আউন্স সোনার মূল্য ৮৫ আউন্স রুপোর সমান। যদি এই অনুপাত ১৩০-এর ২০২০ সালের শীর্ষে পৌঁছে, তবে রুপো সোনার তুলনায় আরও ভালো পারফরম্যান্স দেখাতে পারে। এই পরিস্থিতিতে, বিনিয়োগকারীরা রুপোকে সোনার তুলনায় আরও লাভজনক বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন।
বিনিয়োগের সুযোগ: ‘বাই অন ডিপস’ কৌশল
মোতিলাল ওসওয়াল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমওএফএসএল)-এর বিশ্লেষকরা সোনার উপর দীর্ঘমেয়াদী আশাবাদ বজায় রেখেছেন। তারা পরামর্শ দিয়েছেন যে বিনিয়োগকারীরা ৯০,০০০ থেকে ৯১,০০০ টাকার সমর্থন স্তরে সোনা সংগ্রহ করতে পারেন, যার দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য ১,০৬,০০০ টাকা। এমওএফএসএল-এর বিশ্লেষক মানব মোদি জানিয়েছেন, “২০২৫ সালে সোনা ১৮ শতাংশ লাভ করেছে। নতুন আর্থিক বছরে দ্রুত বৃদ্ধির পর, রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছানোর পর একটি তীব্র বিক্রয় দেখা গেছে।” তিনি আরও বলেন, চাহিদা-সরবরাহের গতিশীলতা সাধারণত অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময়ে সোনার দামের উপর সীমিত প্রভাব ফেলে। বর্তমানে, শুল্ক যুদ্ধ, মুদ্রাস্ফীতির প্রত্যাশা, ধীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা সোনার দাম বাড়াচ্ছে। যদি এই কারণগুলির সমাধান হয়, তবে সোনার দামে নিম্নমুখী চাপ পড়তে পারে।
এঞ্জেল ওয়ান-এর বিশ্লেষকরা স্বল্পমেয়াদী ক্রয়ের জন্য ৯১,৯০০ থেকে ৯২,২০০ টাকার মধ্যে পরিসরের পরামর্শ দিয়েছেন, যার লক্ষ্য ৯৭,০০০ এবং ১,০০,২০০ টাকা, এবং স্টপ লস ৮৯,৪০০ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। এমওএফএসএল-এর বিশ্লেষকরা ট্রেডারদের জন্য নিম্নলিখিত সমর্থন এবং প্রতিরোধ স্তর শেয়ার করেছেন:
- সমর্থন: ৯০,০০০–৯১,০০০ টাকা
- প্রতিরোধ: ৯৯,০০০ টাকা
অক্ষয় তৃতীয়ায় সোনার ঐতিহাসিক পারফরম্যান্স
গত ১৫ বছরে, সোনা ১০ শতাংশের সম্মিলিত বার্ষিক বৃদ্ধির হার (সিএজিআর) প্রদান করেছে, যদিও এর মধ্যে কিছু সংশোধনও ঘটেছে। এটি অর্থনৈতিক অস্থিরতার সময়ে সোনাকে সম্পদ সংরক্ষণের একটি নির্ভরযোগ্য সম্পদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। গত বছরের অক্ষয় তৃতীয়ায় সোনায় বিনিয়োগকারীরা ৩১ শতাংশেরও বেশি রিটার্ন পেয়েছেন। ২০২৫ সালে এখন পর্যন্ত সোনার দাম প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে, যা গত এক দশকের মধ্যে বিনিয়োগকারীদের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী শুরুগুলির মধ্যে একটি।
দেশীয় চাহিদা: আট বছরের সর্বোচ্চ
ভারতের সোনার চাহিদা ১৯৯২ সালে ৩৪০ টন থেকে ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ ৮০০ টনেরও বেশি হয়েছে, যা একটি উল্লেখযোগ্য পুনরুদ্ধার নির্দেশ করে। ২০২৪ সালে ভারত বিশ্বের বৃহত্তম সোনার গহনা গ্রাহক হিসেবে নিজের অবস্থান সুসংহত করেছে, যার বার্ষিক চাহিদার মূল্য ৩.৬ লক্ষ কোটি টাকা। শহুরে এবং গ্রামীণ উভয় বিনিয়োগকারীই সোনাকে সম্পদ সংরক্ষণের একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করে।
বিনিয়োগকারীদের জন্য পরামর্শ
বিশ্লেষকরা সোনায় বিনিয়োগের জন্য একটি সুষম পদ্ধতির পরামর্শ দিচ্ছেন। অক্ষয় তৃতীয়ার পরে মে মাসে সোনার দামে সংশোধন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, বিশেষ করে যদি বৈশ্বিক বাণিজ্য উত্তেজনা হ্রাস পায় বা মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার সম্পর্কিত সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আসে। এমওএফএসএল-এর বিশ্লেষকরা বিনিয়োগকারীদের ৫-১০ শতাংশ দাম সংশোধনের সময় ক্রয়ের পরামর্শ দিয়েছেন, কারণ বর্তমান রেকর্ড স্তরে ঝুঁকি-প্রতিফল অনুপাত অনুকূল নয়।
এঞ্জেল ওয়ান-এর বিশ্লেষকরা স্বল্পমেয়াদী বিনিয়োগকারীদের জন্য সোনার ক্রয় পরিসর এবং লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন, যা ট্রেডারদের জন্যও উপযোগী। দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগকারীদের জন্য, সোনার ইটিএফ, ডিজিটাল সোনা, বা ফিজিক্যাল বার এবং মুদ্রায় বিনিয়োগ একটি জনপ্রিয় পছন্দ হয়ে উঠেছে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বিশ্লেষকদের মতে, সোনার দাম ২০২৬ সালের অক্ষয় তৃতীয়ার মধ্যে ১,০৪,০০০ থেকে ১,১০,০০০ টাকার মধ্যে থাকতে পারে। যদি দাম ১,০০,০০০ টাকার উপরে টিকে থাকে, তবে ১,১০,০০০ টাকার লক্ষ্য অর্জনযোগ্য। তবে, মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত বিলম্বিত হলে বা অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা অপ্রত্যাশিতভাবে শক্তিশালী হলে, সোনার দাম ৮৭,০০০ টাকায় সংহত হতে পারে।
২০২৫ সালের মে মাসে সোনায় বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিনিয়োগকারীদের বাজারের গতিবিধি এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করা উচিত। অক্ষয় তৃতীয়ার পরে দামে সংশোধনের সম্ভাবনা থাকলেও, সোনার দীর্ঘমেয়াদী সম্ভাবনা ইতিবাচক। ‘বাই অন ডিপস’ কৌশল অনুসরণ করে এবং ৯০,০০০–৯১,০০০ টাকার সমর্থন স্তরে ক্রয় করে বিনিয়োগকারীরা লাভবান হতে পারেন। সোনার ঐতিহাসিক পারফরম্যান্স এবং ভারতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা এটিকে একটি নির্ভরযোগ্য সম্পদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবে, বিনিয়োগের আগে আর্থিক উপদেষ্টার সঙ্গে পরামর্শ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।