২০২৯ নির্বাচনের আগে কেন রাজনৈতিক গেমচেঞ্জার হতে পারে অষ্টম বেতন কমিশন

অষ্টম বেতন কমিশন (8th Pay Commission) নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী ও পেনশনভোগীদের মধ্যে উৎসাহের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক মহলেও তীব্র আলোচনা চলছে। ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি…

Why the 8th Pay Commission Could Reshape Election Politics by Boosting Govt Employees’ Vote Bank Before 2029

অষ্টম বেতন কমিশন (8th Pay Commission) নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী ও পেনশনভোগীদের মধ্যে উৎসাহের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক মহলেও তীব্র আলোচনা চলছে। ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার কথা থাকা এই কমিশনটি কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের বেতন ও পেনশনে ৩০-৩৪% বৃদ্ধির সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। এই বৃদ্ধি প্রায় ৫০ লক্ষ কেন্দ্রীয় কর্মী এবং ৬৫ লক্ষ পেনশনভোগীদের জন্য উল্লেখযোগ্য আর্থিক স্বস্তি আনবে। তবে, এই কমিশনের প্রভাব শুধুমাত্র আর্থিক নয়, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এটি ২০২৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে একটি গেমচেঞ্জার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সরকারি কর্মীরা ভারতের একটি শক্তিশালী ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত, এবং এই বেতন বৃদ্ধি তাদের রাজনৈতিক সমর্থনকে প্রভাবিত করতে পারে।

রাজনৈতিক গুরুত্ব
অষ্টম বেতন কমিশনের ঘোষণা ২০২৫ সালের ১৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে। এই ঘোষণা দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে করা হয়েছিল, যা রাজনৈতিক মহলে এর কৌশলগত গুরুত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। দিল্লিতে প্রায় ৪ লক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী রয়েছেন, যারা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভোটব্যাঙ্ক। সরকারি কর্মী ও পেনশনভোগীদের এই বৃহৎ অংশের সমর্থন যে কোনও রাজনৈতিক দলের জন্য নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ। অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে, এটি সরকারি কর্মীদের মধ্যে সন্তুষ্টি বাড়িয়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি তাদের সমর্থন জোরদার করতে পারে।

   

অর্থনীতিবিদ লেখা চক্রবর্তী বলেন, “বেতন ও পেনশন বৃদ্ধি ভোক্তা ব্যয় বাড়িয়ে অর্থনীতিতে গতি আনবে। এটি রাজনৈতিকভাবে একটি সাহসী পদক্ষেপ, যা ভোটারদের মধ্যে সরকারের প্রতি ইতিবাচক ধারণা তৈরি করতে পারে।” তিনি আরও যোগ করেন, এই ধরনের সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও ভারতের ‘ফিসকাল অস্টেরিটি’ এড়ানোর প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করে, যা ভোটারদের কাছে সরকারের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার বার্তা দেয়।

ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে সরকারি কর্মী
ভারতে প্রায় ৪৮.৬২ লক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী এবং ৬৭.৮৫ লক্ষ পেনশনভোগী রয়েছেন, যার মধ্যে প্রায় ১৪ লক্ষ কর্মী এবং ১৯ লক্ষ পেনশনভোগী প্রতিরক্ষা বাহিনীর। এই বিশাল জনগোষ্ঠী একটি শক্তিশালী ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়াও, রাজ্য সরকারি কর্মীদের একটি বড় অংশও কেন্দ্রীয় বেতন কমিশনের সুপারিশের উপর নির্ভর করে, যা এই কমিশনের রাজনৈতিক প্রভাবকে আরও বাড়িয়ে দেয়। পশ্চিমবঙ্গে, যেখানে রাজ্য সরকারি কর্মীদের মধ্যে মহার্ঘ ভাতা (ডিএ) নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অসন্তোষ রয়েছে, অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশ রাজ্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বারবার দাবি করেছেন যে, তৃণমূল কংগ্রেস সরকার রাজ্য সরকারি কর্মীদের ডিএ প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে, যা ২০২৯ সালের নির্বাচনের আগে একটি বড় রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে উঠতে পারে।

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব
অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশের ফলে সরকারি কর্মীদের বেতন ৩০-৩৪% বৃদ্ধি পেতে পারে, যা নিম্ন স্তরের কর্মীদের জন্য সর্বনিম্ন বেতন ১৮,০০০ টাকা থেকে ৫১,৪৮০ টাকায় উন্নীত করতে পারে। এই বৃদ্ধি ভোক্তা ব্যয় বাড়িয়ে দ্রুতগতির ভোক্তা পণ্য (FMCG), রিয়েল এস্টেট, এবং অটোমোবাইল খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কোটাক ইনস্টিটিউশনাল ইকুইটিসের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, এই বেতন বৃদ্ধির ফলে ১-১.৫ লক্ষ কোটি টাকার অতিরিক্ত সঞ্চয় সৃষ্টি হতে পারে, যা ইকুইটি এবং ব্যাঙ্ক আমানতে প্রবাহিত হবে। এই অর্থনৈতিক উত্থান ক্ষমতাসীন দলের জন্য ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করতে পারে, যা ২০২৯ সালের নির্বাচনে তাদের পক্ষে কাজ করতে পারে।

তবে, এই বেতন বৃদ্ধির ফলে সরকারের উপর ১.৮ লক্ষ কোটি টাকার অতিরিক্ত আর্থিক বোঝা পড়তে পারে, যা মূল্যস্ফীতির চাপ সৃষ্টি করতে পারে। অর্থনীতিবিদ ডি.কে. শ্রীবাস্তব বলেন, “বেতন ও পেনশন বৃদ্ধির ফলে ২০২৬-২৭ সালে সরকারের রাজস্ব ব্যয় ৯.৯% বৃদ্ধি পেতে পারে, যা সরকারের পুঁজি ব্যয়ের জন্য ফিসকাল স্পেস কমিয়ে দিতে পারে।” এই আর্থিক চ্যালেঞ্জ বিরোধী দলগুলিকে সরকারের সমালোচনার সুযোগ দিতে পারে, যা ২০২৯ সালের নির্বাচনে একটি বড় ইস্যু হয়ে উঠতে পারে।

Advertisements

রাজনৈতিক কৌশল
অষ্টম বেতন কমিশনের ঘোষণা এবং এর সম্ভাব্য বাস্তবায়ন ২০২৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন দলের জন্য একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে এই কমিশনের সম্ভাবনা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছিল, এবং এটি ২০২৫ সালে ঘোষিত হওয়ায় এর রাজনৈতিক গুরুত্ব আরও বেড়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের সংগঠন, যেমন অল ইন্ডিয়া ডিফেন্স এমপ্লয়িজ ফেডারেশন, এই কমিশনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিল। এই দাবি পূরণের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল তাদের প্রতি সরকারি কর্মীদের সমর্থন জোরদার করার চেষ্টা করছে।

পশ্চিমবঙ্গে, তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারি কর্মীদের ডিএ নিয়ে অসন্তোষের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশ রাজ্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করবে, এবং তৃণমূলকে তাদের বেতন নীতি পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করতে পারে। এটি ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন এবং ২০২৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে উঠতে পারে।

চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা
অষ্টম বেতন কমিশনের বাস্তবায়নের পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, এর জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক ব্যয় সরকারের রাজস্ব ঘাটতি বাড়াতে পারে। দ্বিতীয়ত, মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে। তৃতীয়ত, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারি কর্মীদের মধ্যে বেতনের বৈষম্য কমানোর জন্য সমন্বয় প্রয়োজন। তবে, এই কমিশনের মাধ্যমে সরকারি কর্মীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে এবং অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার হবে।

অষ্টম বেতন কমিশন শুধুমাত্র আর্থিক সংস্কারই নয়, বরং ২০২৯ সালের নির্বাচনের আগে একটি রাজনৈতিক গেমচেঞ্জার হিসেবে কাজ করতে পারে। সরকারি কর্মী ও পেনশনভোগীদের এই বিশাল ভোটব্যাঙ্কের সমর্থন ক্ষমতাসীন দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে। পশ্চিমবঙ্গে এই কমিশনের প্রভাব রাজ্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করবে এবং তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলির সমালোচনাকে আরও জোরদার করতে পারে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, অষ্টম বেতন কমিশন ভারতের রাজনীতির গতিপথকে প্রভাবিত করতে পারে।