কথায় বলে সরষের মধ্যেই ভূত! তা সে ভূত থাকুক বা না থাকুক। বিশুদ্ধ সরষের তেলের ঝাঝে মানুষ থেকে শুরু করে ভূত, সবারই চোখে জল ঝরতে বাধ্য। বঙ্গ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এই তেল। কিন্তু শুনলে অবাক হবেন, আমেরিকা সহ ইউরোপের একাধিক দেশে ব্যান করা হয়েছে আমাদের এই সাধের তেলকে। একেবারে সরকারি নির্দেশ জারি করে বিষাক্ত ঘোষণা করা হয়েছে এই তেলকে। তাহলে এই যে আমরা প্রতিদিন কব্জি ডুবিয়ে বাড়িতে সরষের তেলে রান্না করা খাবার সাবাড় করছি গোগ্রাসে। তাহলে কি আমরা জেনে শুনেও বিষ পান করছি ?
এতকাল ধরে আমরা জেনে এসেছি, সরষের তেলের মত উপকারী তেল আর হয় না। শুধু রান্নায় নয় মালিশের ক্ষেত্রেও ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে এই তেলের। স্নানের আগে এই তেল মেখে স্নান করার রেওয়াজ অনেক বাঙালি পরিবারের মধ্যে এখনও আছে। আর আমাদের প্রিয় মাটন বা চিকেন রান্নাতে সরষের তেল না হলে রান্নাটা জমবেই না। বাজারে যতই বিভিন্ন রিফাইন বা সয়াবিন তেলের রমরমা চলুক, বাঙালিদের রান্নাঘরে সরষের তেলের গুরুত্ব যেন আলাদাই।
কিন্তু কেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ বাতিল করছে এই তেলকে? ১৯৫০ এর দশকেই এই নিয়ে বিস্তর গবেষণা শুরু হয়েছিল। সেই সময় গবেষণায় সরষের তেলের শক্তিশালী গন্ধের কারণ হিসেবে পাওয়া যায় ইরুসিক অ্যাসিড এবং গ্লুকোসিনোলেটস। যদিও সরষে গাছ নিজের শত্রুদের বিরুদ্ধে ঢাল হিসাবেই এই পদার্থগুলিকে ব্যবহার করে। মার্কিন ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’-এর মতে, সর্ষের তেলে ইরুসিক অ্যাসিডের মাত্রা যথেষ্ট বেশি। এটি এমন একটি ফ্যাটি অ্যাসিড এবং মানুষের জন্য মোটেও স্বাস্থ্যকর নয় বলেই দাবি করছে মার্কিন খাদ্য দফতর। মার্কিন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অ্যাসিড বেশি মাত্রায় শরীরে ঢুকলে তা বিপাকক্রিয়ার উপরে প্রভাব ফেলবে।
ফলে রান্নায় যদি একগাদা সরষের তেল ব্যবহার করা হয়, তা হলে সেই খাবার হজম করতেও যেমন সময় লাগবে বেশি, তেমনই পেটের গন্ডগোলও অবধারিত। মার্কিন খাদ্য দফতর আরও জানিয়েছে, এই যৌগ নাকি বেশি পরিমাণে মানবদেহে ঢুকলে মস্তিষ্কেরও ক্ষতি হতে পারে। স্মৃতিশক্তি কমতে পারে ধীরে ধীরে। এই অ্যাসিড সব চেয়ে বেশি ক্ষতি করে হার্টের। হৃদ্পেশিতে চর্বি জমা হয়ে হৃদ্রোগের সম্ভাবনা বাড়ে। তাই সরষের তেলের বদলে সয়াবিন তেল ও অলিভ তেলই ব্যবহার করেন আমেরিকা সহ ইউরোপের একাধিক দেশের মানুষজন।
অথছচ আমাদের দেশের ডাক্তারদের বক্তব্য কিন্তু ঠিক এর বিপরীত। আমাদের অনেকেরই মনে আছে, আমাদের বাঙালীদের সর্বজনীন দাদা অর্থাৎ সৌরভ গাঙ্গুলীর হার্টে কিছুদিন আগেই স্টেন্ট বসেছিল। সে সময় তার ডাক্তার তাকে কিন্তু এই সরষের তেলে রান্না করা খাবারই খেতে বলেছিলেন। অর্থাৎ ভারতবর্ষে এখনো অব্দি ডাক্তারেরা সর্ষের তেলকে কিন্তু নিরাপদ বলেই মনে করছেন, যতই বিদেশে এটি ব্যান হোক না কেন। ভারতীয় চিকিৎসকদের দাবি, সর্ষের বীজে থাকা তামা, লোহা, ম্যাগনেশিয়াম এবং সেলেনিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
সর্ষের তেল পরিমিত পরিমাণে রান্নায় ব্যবহার করলে ভাল কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ে। খারাপ কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রিত হয়। সর্ষের তেলে থাকে ওমেগা ৩ ও ওমেগা ৬ ফ্যাটি অ্যাসিড, যা শরীরে কোলেস্টেরলের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে।কিন্তু সবশেষে সেই একটা কথাই বলা যায়। সব জিনিসই ভালো, কিন্তু কোনোকিছুই বেশি বাড়াবাড়ি ভালো না। সরষের তেলের ক্ষেত্রেও বোধ হয় এই নিয়মটাই প্রযোজ্য। তাই নিয়ম মেনে খাওয়াটাই বোধহয় ভাল সবক্ষেত্রেই।