ভারতের সোনাভিত্তিক ঋণ বা ‘গোল্ড লোন’ বাজার অভূতপূর্ব সাফল্যের পথে (Gold Loans)। প্র্যাক্সিস গ্লোবাল অ্যালায়েন্স-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই বাজারের আকার পৌঁছে গেছে প্রায় ৮৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছুঁয়ে, আর ২০২৪-২৫ সালে তা আরও বাড়বে বলে অনুমান করা হচ্ছে। সোনার দাম ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী হওয়া, ডিজিটাল পরিষেবার সহজলভ্যতা এবং হঠাৎ প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক নগদের প্রয়োজনীয়তা—এই সব কারণেই সোনার বন্ধকী ঋণ আজ ভারতীয় পরিবার ও ক্ষুদ্র ব্যবসার কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও নির্ভরযোগ্য আর্থিক বিকল্পে পরিণত হয়েছে।
ভারতীয় পরিবারে সোনার আবেগ ও আর্থিক গুরুত্ব:
ভারতীয় সংস্কৃতিতে সোনা শুধু অলঙ্কার নয়, বরং আবেগের সঞ্চয় ও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলে আসা এক নিরাপত্তা বলয়। গ্রামীণ পরিবারে কৃষি আয়ের অনিশ্চয়তা বা বিয়ে-শাদির মতো আকস্মিক খরচের সময় সোনা বহুদিন ধরেই জরুরি ভরসা। শহরাঞ্চলে আবার সোনা নিরাপদ সঞ্চয় হিসেবে থেকে যায়, যা প্রয়োজনে মুহূর্তের মধ্যে নগদে রূপান্তর করা যায়। এই সর্বজনীন উপস্থিতিই সোনার ঋণকে ভারতের অন্যতম অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সহজলভ্য আর্থিক সমাধানে পরিণত করেছে।
২০২৫-এ সোনার ঋণ বাজার কেন এত বাড়ছে?
বিশ্ব সোনা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে সোনার দামে ব্যাপক বৃদ্ধি হয়েছে। ২০২২ থেকে ২০২৩-এ প্রায় ২০% বৃদ্ধি, তার পরের বছরেও আরও ২০% বৃদ্ধি দেখা গেছে। ২০২৫ সালে সেই দাম আরও ২৬% বেড়েছে। ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলির সোনা কেনা এবং নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে সোনার চাহিদা এই ঊর্ধ্বগতির প্রধান কারণ।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, এআই-চালিত মূল্যায়ন ব্যবস্থা এবং গ্রামীণ অঞ্চলের জন্য কম ব্যান্ডউইথে চলতে সক্ষম মোবাইল অ্যাপ আজ সোনার ঋণকে সহজ, স্বচ্ছ এবং গ্রাহকবান্ধব করেছে। এখন এমনকি প্রথমবার ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রেও বিভ্রান্তি বা ভয় কমে গেছে।
সোনার ঋণ কেন এত জনপ্রিয়?
১. দ্রুত ঋণ, কম কাগজপত্র:
পার্সোনাল লোন বা অন্য ঋণে যেখানে বহুদিন ধরে কেওয়াইসি প্রক্রিয়া চলে, সেখানে সোনার ঋণে লাগে শুধু মৌলিক পরিচয়পত্র। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই টাকা হাতে পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা, সিবিল স্কোর খারাপ হলেও সমস্যা নেই, কারণ সোনা নিজেই জামানত হিসেবে ঝুঁকি কমিয়ে দেয়।
২. প্রত্যন্ত এলাকায় সহজলভ্যতা:
আগে যেখানে ব্যাংকে গিয়ে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হত, আজ সেখানে ফিনটেক কোম্পানি ও ডোরস্টেপ সার্ভিসের কারণে গ্রামীণ ও আধা-শহুরে এলাকাতেও সোনার ঋণ সহজলভ্য হয়েছে। আর্থিক জটিলতা ছাড়াই সাধারণ মানুষও ঘরে বসেই সুবিধা পাচ্ছেন।
৩. সাশ্রয়ী সুদের হার:
যেহেতু এটি জামানত-ভিত্তিক ঋণ, তাই সুদের হারও কম। ক্রেডিট কার্ড বা পার্সোনাল লোনের তুলনায় এটি অনেক সস্তা। স্বল্পমেয়াদি প্রয়োজন মেটাতে তাই সোনার ঋণ খরচের দিক থেকে বেশ লাভজনক।
৪. নমনীয় পরিশোধের সুযোগ:
আজকের ঋণদাতারা শুধু এককালীন পরিশোধের শর্তে সীমাবদ্ধ রাখছেন না। গ্রাহকরা চাইলে ইএমআই, শুধু সুদের টাকা পরিশোধ অথবা বুলেট পেমেন্ট পদ্ধতি বেছে নিতে পারেন। আয়ের ধরন অনুযায়ী পরিশোধের সুবিধা থাকায় ঋণগ্রহীতার উপর চাপও কমে।
সোনা বন্ধক রাখার আগে যা জানা জরুরি:
তবে সহজ প্রক্রিয়ার আড়ালেও কিছু বিষয় মাথায় রাখা জরুরি—
মূল্যায়ন বোঝা: ঋণের অঙ্ক নির্ভর করে সোনার বিশুদ্ধতা ও ওজনের উপর। তাই একাধিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মূল্যায়ন জেনে নেওয়া ভালো।
সুদের কাঠামো: যদিও সুদের হার তুলনামূলক কম, তবে প্রসেসিং ফি, সার্ভিস চার্জ ইত্যাদি খরচ ভিন্ন হতে পারে।
সঠিক পরিশোধ পদ্ধতি নির্বাচন: আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ইএমআই বা অন্য বিকল্প বেছে নেওয়া উচিত।
ঋণ খেলাপির ঝুঁকি: সময়মতো পরিশোধ না হলে সোনা নিলামে বিক্রি হয়ে যেতে পারে। তাই প্রয়োজনমতোই ঋণ নেওয়া জরুরি।
শর্তাবলী ভালোভাবে পড়া: আগাম পরিশোধের চার্জ, ফি বা সময়সীমা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখা দরকার।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ:
এআই-নির্ভর ঋণ মূল্যায়ন, নমনীয় পরিশোধ পদ্ধতি এবং ডিজিটাল স্বচ্ছতার কারণে সোনার ঋণ আজ শুধু জরুরি প্রয়োজনে নগদ নয়, বরং একটি সুগঠিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক পরিষেবা। তবে দায়িত্বশীলভাবে ঋণ গ্রহণই একমাত্র উপায় যাতে এই সুযোগ প্রকৃত অর্থে আশীর্বাদ হয়ে ওঠে।
যথাযথ সচেতনতা নিয়ে ব্যবহৃত হলে, পরিবারের অলঙ্কার শিক্ষার খরচ, স্বাস্থ্যসেবা বা ক্ষুদ্র ব্যবসার বিকাশে কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী ঋণের ফাঁদে না পড়ে সোনাকে পরিণত করা যায় ভবিষ্যতের সফল বিনিয়োগে।