GST কাউন্সিলে রাজ্যের ক্ষমতা কতটা? জানুন বিশদে

ভারতে পণ্য ও পরিষেবা কর বা জিএসটি (GST) প্রায়ই স্বাধীনতার পর থেকে সবচেয়ে বড় কর সংস্কার হিসেবে বর্ণিত হয়। ২০১৭ সালের ১লা জুলাই চালু হওয়া…

FMCG Stocks Surge: HUL, ITC, Britannia, Nestle Gain as GST on Key Food Items Cut to 5%

ভারতে পণ্য ও পরিষেবা কর বা জিএসটি (GST) প্রায়ই স্বাধীনতার পর থেকে সবচেয়ে বড় কর সংস্কার হিসেবে বর্ণিত হয়। ২০১৭ সালের ১লা জুলাই চালু হওয়া এই নতুন কর ব্যবস্থার মূল দায়িত্বে রয়েছে জিএসটি কাউন্সিল, একটি সাংবিধানিক সংস্থা যা কেন্দ্র ও রাজ্যকে একত্রিত করে একক কর কাঠামো নিশ্চিত করার জন্য গঠিত হয়েছে। শুধুমাত্র নীতিনির্ধারণ নয়, এই কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত সরাসরি প্রভাব ফেলে ব্যবসা, বাজার এবং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে।

জিএসটির আগে ভারতের কর কাঠামো ছিল অত্যন্ত জটিল ও বিভক্ত। প্রতিটি রাজ্যের নিজস্ব নিয়ম ছিল, ফলে অনেক ক্ষেত্রে একই পণ্যের উপর একাধিক স্তরে কর বসত। এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে পণ্য পৌঁছতে গিয়ে দাম আরও বেড়ে যেত, যার ভার বহন করতে হতো শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদেরই। জিএসটি চালুর মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা হয়। লক্ষ্য ছিল এক দেশ, এক কর ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যাতে ব্যবসায় খরচ কমে এবং বাজার আরও স্বচ্ছ হয়।

   

কাউন্সিলের গঠন এমনভাবে করা হয়েছে যাতে কেন্দ্র ও রাজ্য—উভয়েরই সমান ভূমিকা থাকে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী (বর্তমানে নির্মলা সীতারামন) সর্বদা কাউন্সিলের চেয়ারপার্সন হন। সঙ্গে থাকেন কেন্দ্রীয় অর্থ প্রতিমন্ত্রী এবং প্রতিটি রাজ্যের অর্থ বা করমন্ত্রী। রাজ্যগুলির মধ্যে একজন ভাইস চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন, আর কেন্দ্রীয় রাজস্ব সচিব কাউন্সিলের সচিবের ভূমিকা পালন করেন। সিবিআইসি (CBIC)-এর চেয়ারম্যান স্থায়ী আমন্ত্রিত সদস্য।

ভোটাধিকারও সমন্বিতভাবে নির্ধারিত—কেন্দ্রের ভোটের অংশ এক-তৃতীয়াংশ এবং সমস্ত রাজ্য মিলে দুই-তৃতীয়াংশ। কোনো সিদ্ধান্ত পাশ করতে হলে ৭৫ শতাংশ ভোটের সমর্থন প্রয়োজন। ফলে কেন্দ্র বা রাজ্য কেউই এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে না, যা ভারতের ফেডারেল কাঠামো বজায় রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

শুধু করহার নির্ধারণই নয়, কাউন্সিলের কাজ বহুস্তরীয়। কোন পণ্য ও পরিষেবা করমুক্ত থাকবে, ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য কী ছাড় দেওয়া হবে, রাজ্যের রাজস্ব ক্ষতি হলে কীভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে—এসবই সিদ্ধান্ত নেয় জিএসটি কাউন্সিল। বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা জাতীয় সঙ্কটে অতিরিক্ত সেস আরোপ করার বিষয়েও এখানেই সিদ্ধান্ত হয়। এমনকি বহু প্রতীক্ষিত জ্বালানি পণ্য—পেট্রোল, ডিজেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসকে জিএসটির আওতায় আনার প্রশ্নটিও কাউন্সিলের হাতে রয়েছে।

যদিও কাউন্সিল মূলত ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাজ করার জন্য তৈরি, তবুও সময়ে সময়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। ২০২২ সালের মোহিত মিনারেলস মামলায় সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করে জানায় যে, কাউন্সিলের সুপারিশ বাধ্যতামূলক নয়। ফলে রাজ্যগুলির স্বাধীনতা আছে তা মানা বা না মানার।

সবচেয়ে বড় দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে রাজস্ব ক্ষতিপূরণ নিয়ে। ২০১৭ সালে জিএসটি চালুর সময় কেন্দ্র প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল পাঁচ বছর রাজস্ব ঘাটতি পূরণ করবে। কিন্তু জুন ২০২২-এ সেই সময়সীমা শেষ হয়ে গেলে কেরালা, ছত্তিশগড়ের মতো রাজ্যগুলি বাড়ানোর দাবি তোলে। কেন্দ্র তা মানেনি, ফলে রাজনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয়।

একইভাবে ২০১৯-২০ সালে লটারির উপর করহার নিয়ে তীব্র মতভেদ হয়। আগে রাজ্য-চালিত লটারিতে কর ছিল ১২ শতাংশ, আর বেসরকারি পরিচালিত লটারিতে ২৮ শতাংশ। পরে কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নেয়, সব লটারির উপর সমান ২৮ শতাংশ কর ধার্য হবে। কেরালা, পাঞ্জাব ও উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি প্রবল আপত্তি জানালেও শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়।

Advertisements

বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হল জিএসটির করহার সরলীকরণ। এখন চারটি প্রধান স্ল্যাব রয়েছে—৫, ১২, ১৮ ও ২৮ শতাংশ। প্রস্তাব উঠেছে তা কমিয়ে দুটি—৫ ও ১৮ শতাংশে আনা হোক। প্রস্তাব অনুযায়ী সিমেন্ট, প্যাকেজড জুস, কার্বোনেটেড ড্রিঙ্কস ও এক হাজার টাকার বেশি মূল্যের রেডিমেড পোশাকের উপর কর কমানো হতে পারে।

কিন্তু কর্ণাটক-সহ একাধিক রাজ্য এর বিরোধিতা করছে। তাদের দাবি, এতে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হবে। কর্ণাটকের অর্থমন্ত্রী প্রকাশ্যে বলেছেন, “জিএসটি একটি ফেডারেল কাঠামো, এখানে একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।” ফলে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে আগামী সেপ্টেম্বর ২০২৫-এর বৈঠকে।

সাধারণ ভোক্তাদের জন্য জিএসটি কাউন্সিলের প্রতিটি সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ। করহার কমলে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিস সস্তা হয়, আবার কর বাড়লে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। কোভিড-১৯ মহামারির সময় কাউন্সিল অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর ও ভ্যাকসিনের উপর কর কমিয়ে স্বস্তি দিয়েছিল।

এছাড়াও ই-ওয়ে বিল, ই-ইনভয়েসিং, ইলেকট্রিক গাড়ির উপর করছাড়, সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনের জন্য কম কর—এসব সিদ্ধান্তও এসেছে কাউন্সিল থেকে, যা ব্যবসা সহজ করেছে এবং অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে।

২০০০-এর দশকের শুরু থেকেই জিএসটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। তবে বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন ছিল। ২০১৬ সালে সংসদে সংশোধনী পাশ হয় এবং ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬-তে আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয় জিএসটি কাউন্সিল। প্রথম বৈঠক হয় এর কিছুদিন পরেই। আর এর কম এক বছরের মধ্যে, ১ জুলাই ২০১৭-তে সারা দেশে চালু হয় জিএসটি।

ভারতের আর্থিক নীতিতে জিএসটি কাউন্সিল আজ কেন্দ্রীয় ভূমিকায়। এটি শুধু করহার নির্ধারণ করে না, বরং ফেডারেল কাঠামোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে অর্থনৈতিক নীতির রূপরেখা ঠিক করে। ব্যবসা, রাজস্ব ও জনগণের জীবনে এর প্রভাব প্রতিনিয়ত অনুভূত হয়। তাই কাউন্সিলের প্রতিটি বৈঠক শুধু রাজনীতি নয়, সাধারণ মানুষের পকেটের সঙ্গেও সরাসরি যুক্ত।