ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি (IT) শিল্পে বেঙ্গালুরু দীর্ঘদিন ধরে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। এই শহর, যিনি ভারতের ‘সিলিকন ভ্যালি’ নামে পরিচিত, আইটি পেশাদারদের জন্য উচ্চ বেতন ও আকর্ষণীয় জীবনযাত্রার প্রতিশ্রুতি দেয়। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা, যদিও একটি উদীয়মান আইটি হাব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে, তবুও বেতনের ক্ষেত্রে বেঙ্গালুরুর (West Bengal vs Bangalore) তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে। ২০২৫ সালের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, কলকাতা এবং বেঙ্গালুরুর মধ্যে আইটি পেশাদারদের বেতনের ব্যবধান উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রতিবেদনে আমরা এই ব্যবধানের কারণ, প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করব।
বেতনের ব্যবধান: সংখ্যার চিত্র
২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, বেঙ্গালুরুতে আইটি পেশাদারদের গড় বার্ষিক বেতন প্রায় ৮.৮ লক্ষ টাকা, যেখানে কলকাতায় এটি ৫.৯ লক্ষ টাকার আশেপাশে রয়েছে। এই তথ্যটি সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত পোস্ট থেকে পাওয়া গেছে। এই ২.৯ লক্ষ টাকার ব্যবধান কলকাতার আইটি পেশাদারদের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। পেস্কেলের তথ্য অনুযায়ী, কলকাতায় গড় বেতন প্রায় ৫.১১ লক্ষ টাকা, যেখানে বেঙ্গালুরুতে আইটি-সংশ্লিষ্ট পেশায় বেতন অনেক ক্ষেত্রে ১২ লক্ষ টাকা বা তার বেশি হতে পারে। এই ব্যবধানের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে, যার মধ্যে জীবনযাত্রার খরচ, শিল্পের ঘনত্ব এবং দক্ষতার চাহিদা অন্যতম।
জীবনযাত্রার খরচের প্রভাব
কলকাতার জীবনযাত্রার খরচ ভারতের অন্যান্য মেট্রো শহরের তুলনায় তুলনামূলকভাবে কম। এক্সপ্যাটিস্টানের ২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, বেঙ্গালুরুতে জীবনযাত্রার খরচ কলকাতার তুলনায় ১৭% বেশি। উদাহরণস্বরূপ, বেঙ্গালুরুতে ভাড়া বাড়ির খরচ কলকাতার তুলনায় ৫৮.১% বেশি। কলকাতায় একজন একক ব্যক্তির জন্য মাসিক জীবনযাত্রার খরচ প্রায় ৩০,০০০ টাকা হতে পারে, যেখানে বেঙ্গালুরুতে এটি ৪০,০০০ টাকা বা তার বেশি। এই খরচের পার্থক্য আইটি কোম্পানিগুলোর বেতন নির্ধারণে প্রভাব ফেলে। বেঙ্গালুরুতে উচ্চ জীবনযাত্রার খরচের কারণে কোম্পানিগুলো বেশি বেতন প্রদান করে, যা পেশাদারদের জন্য এই শহরকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
আইটি শিল্পের ঘনত্ব ও দক্ষতার চাহিদা
বেঙ্গালুরু ভারতের আইটি শিল্পের কেন্দ্রস্থল। এখানে ইনফোসিস, উইপ্রো, টিসিএস এবং বহুজাতিক কোম্পানি যেমন গুগল, মাইক্রোসফট এবং অ্যামাজনের মতো প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় বা বড় অফিস রয়েছে। এই কোম্পানিগুলো ক্লাউড কম্পিউটিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), এবং মেশিন লার্নিংয়ের মতো উচ্চ-দক্ষতার ক্ষেত্রে পেশাদারদের নিয়োগ করে, যার ফলে বেতনের পরিমাণও বেশি হয়। লিঙ্কডইনের একটি ২০১৮ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, বেঙ্গালুরুতে হার্ডওয়্যার ও নেটওয়ার্কিং পেশাদারদের গড় বেতন প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা, যেখানে সফটওয়্যার ডেভেলপারদের বেতন ১২ লক্ষ টাকার কাছাকাছি।
অন্যদিকে, কলকাতায় আইটি শিল্প তুলনামূলকভাবে নতুন এবং এখনও বিকাশের পর্যায়ে রয়েছে। কলকাতায় টিসিএস, কগনিজেন্ট এবং আইবিএম-এর মতো কিছু বড় কোম্পানির উপস্থিতি থাকলেও, বেঙ্গালুরুর তুলনায় এখানে উচ্চ-দক্ষতার প্রকল্পের সংখ্যা কম। ফলে, কলকাতায় আইটি পেশাদারদের বেতন তুলনামূলকভাবে কম। উদাহরণস্বরূপ, কলকাতায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের গড় বেতন ৫.৯ লক্ষ টাকা, যেখানে বেঙ্গালুরুতে এটি ৮.৮ লক্ষ টাকা।
লিঙ্গভিত্তিক বেতন বৈষম্য
২০২৫ সালের পেস্কেলের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের আইটি শিল্পে লিঙ্গভিত্তিক বেতন বৈষম্য এখনও একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা। বেঙ্গালুরুতে পুরুষ আইটি পেশাদারদের গড় বেতন প্রায় ১৯.৫ লক্ষ টাকা, যেখানে মহিলাদের গড় বেতন ১৫.১ লক্ষ টাকা। কলকাতায় এই বৈষম্য কিছুটা কম হলেও, সামগ্রিকভাবে মহিলা পেশাদারদের বেতন পুরুষদের তুলনায় কম। এই বৈষম্য কলকাতার আইটি পেশাদারদের জন্য অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জ তৈরি করে, বিশেষ করে যখন তারা বেঙ্গালুরুর মতো শহরে স্থানান্তরের কথা বিবেচনা করে।
পশ্চিমবঙ্গের চ্যালেঞ্জ
পশ্চিমবঙ্গে আইটি শিল্পের বিকাশের জন্য সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, যেমন নিউ টাউন এবং সল্টলেকে আইটি হাব গড়ে তোলা। তবে, বেঙ্গালুরুর তুলনায় এখানে বড় কোম্পানির সংখ্যা এবং উচ্চ-দক্ষতার প্রকল্পের সুযোগ কম। এছাড়া, পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৈষম্য নিয়ে ২০১৬ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, রাজ্য সরকারের কর্মচারীদের বেতন কেন্দ্রীয় সরকারের তুলনায় অনেক কম। এই প্রবণতা আইটি শিল্পেও প্রতিফলিত হয়, যেখানে কলকাতায় বেতন বেঙ্গালুরুর তুলনায় প্রায় ৩০-৪০% কম।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
পশ্চিমবঙ্গের আইটি শিল্পের সম্ভাবনা উজ্জ্বল, তবে বেতনের ব্যবধান কমাতে কিছু পদক্ষেপ প্রয়োজন। সরকার এবং বেসরকারি খাতের সহযোগিতায় আরও বড় কোম্পানিকে কলকাতায় আকৃষ্ট করা, দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি চালু করা এবং অবকাঠামো উন্নত করা এই ব্যবধান কমাতে সাহায্য করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কলকাতায় আরও ক্লাউড কম্পিউটিং এবং এআই-ভিত্তিক প্রকল্প চালু করা হলে, উচ্চ বেতনের সুযোগ বাড়বে। এছাড়া, ডিজিটাল সাক্ষরতা এবং স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের প্রসারও কলকাতাকে বেঙ্গালুরুর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
বেঙ্গালুরুতে আইটি শিল্পের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ এবং উচ্চ জীবনযাত্রার খরচের কারণে বেতন বেশি হলেও, কলকাতার কম খরচের জীবনযাত্রা এবং উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি এটিকে একটি সম্ভাবনাময় আইটি হাব হিসেবে গড়ে তুলছে। তবে, বেতনের ব্যবধান কমাতে সরকার এবং শিল্প মহলের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
২০২৫ সালে কলকাতা এবং বেঙ্গালুরুর মধ্যে আইটি বেতনের ব্যবধান উল্লেখযোগ্য। বেঙ্গালুরুর উচ্চ বেতন এবং আধুনিক আইটি ইকোসিস্টেম এটিকে পেশাদারদের জন্য আকর্ষণীয় করে তুললেও, কলকাতার কম জীবনযাত্রার খরচ এবং উদীয়মান আইটি হাব হিসেবে সম্ভাবনা এটিকে ভবিষ্যতের জন্য আশাবাদী করে। সঠিক নীতি এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে কলকাতা এই ব্যবধান কমিয়ে ভারতের আইটি মানচিত্রে আরও শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারে।