অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বড় ধাক্কা, পিছিয়ে পড়ছে বাংলা, উদ্বেগ বাড়ছে প্রশাসনে

পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal) দীর্ঘদিন ধরেই শিল্প এবং বিনিয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে একগুঁয়ে নীতির জন্য সমালোচিত। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রক এবং পরিসংখ্যান ও কর্মসূচি রূপায়ণ মন্ত্রকের…

note

পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal) দীর্ঘদিন ধরেই শিল্প এবং বিনিয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে একগুঁয়ে নীতির জন্য সমালোচিত। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রক এবং পরিসংখ্যান ও কর্মসূচি রূপায়ণ মন্ত্রকের যৌথ রিপোর্টে উঠে এসেছে, গত কয়েক বছরে নতুন কোম্পানি নিবন্ধন এবং বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ দেশের অন্যতম পশ্চাৎপদ রাজ্যগুলির মধ্যে একটি।

নতুন কোম্পানি নিবন্ধনে পশ্চিমবঙ্গের ভগ্নদশা:
কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত তিন বছরে সারা দেশে মোট ৫.২৫ লক্ষ নতুন কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন হয়েছে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যা মাত্র ২৫,০০৮—জাতীয় সংখ্যার মাত্র ৪.৭৬ শতাংশ। মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, কর্ণাটক, এবং তেলেঙ্গানা এই ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে।

   

এই সংখ্যাটি স্পষ্ট করে দেয় যে, পশ্চিমবঙ্গ এখন আর নতুন উদ্যোগের জন্য অনুকূল স্থান নয়। তরুণ উদ্যোক্তা এবং শিল্পপতিরা যে রাজ্যের বাইরে অন্যত্র তাদের ব্যবসা গড়ে তোলার দিকে ঝুঁকছেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় আরও একটি তথ্য থেকে।

অন্য রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে সংস্থাগুলি:
২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে, মোট ২,২২৭টি কোম্পানি পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাদের প্রধান কার্যালয় অন্য রাজ্যে স্থানান্তর করেছে। এর মধ্যে ৩৯টি সংস্থা মুম্বই স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত। ‘কোম্পানিজ অ্যাক্ট, ২০১৩’-এর ধারা ১৩(৪) অনুযায়ী, সংস্থাগুলি তাদের নিবন্ধিত অফিস এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে স্থানান্তর করতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, সংস্থা স্থানান্তরের পিছনে বড় কারণগুলি হল পরিচালনায় নমনীয়তা, খরচের নিয়ন্ত্রণ, অবকাঠামোর মান এবং প্রশাসনিক সুবিধা।

এই তথ্য আরও স্পষ্ট করে দেয় যে, পশ্চিমবঙ্গে ব্যবসা চালানো অনেক সংস্থার পক্ষে আর আর্থিক বা প্রশাসনিক দিক থেকে লাভজনক নয়।

এফডিআই আকর্ষণেও পিছিয়ে পশ্চিমবঙ্গ:
বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও রাজ্যটির অবস্থা উদ্বেগজনক। ২০১৯ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে পশ্চিমবঙ্গ মাত্র ৬৬৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের এফডিআই আকর্ষণ করতে পেরেছে। এর বিপরীতে মহারাষ্ট্র একাই ২৬,২০৪ মিলিয়ন ডলার আকর্ষণ করেছে। ফলে এফডিআই প্রাপ্তির দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের স্থান দেশজুড়ে নবম। যা একাধিক গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের থেকেও পিছিয়ে।

Advertisements

এই ধরনের কম বিনিয়োগ মানে রাজ্যে শিল্প সম্প্রসারণের সুযোগ কমে যাওয়া, কর্মসংস্থান না বাড়া এবং আর্থিক প্রবৃদ্ধির গতি হ্রাস পাওয়া।

বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা—নীতি নিয়ে প্রশ্ন:
অর্থনীতি ও শিল্প পর্যবেক্ষকদের মতে, রাজ্য সরকারের দু’টি নীতি এই পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ।
প্রথমত, রাজ্যের ভূমি সংক্রান্ত নীতি, যেখানে সরকার শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণে হস্তক্ষেপ করবে না বলে জানিয়েছে, সেটি বড় বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করছে। শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়তে বড় প্লটের জমি একত্রে প্রয়োজন হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের জমির চাষযোগ্য স্বরূপ এবং টুকরো মালিকানার কারণে, জমি সংগ্রহ একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।

দ্বিতীয়ত, রাজ্য সরকার নতুন কোনও সংস্থাকে স্পেশাল ইকোনমিক জোন (SEZ) অনুমোদন দিতে নারাজ। তথ্যপ্রযুক্তি (IT) ও তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবা (ITeS) ক্ষেত্রে বড় বিনিয়োগ আনার জন্য SEZ স্ট্যাটাস গুরুত্বপূর্ণ। দেশের অন্যান্য রাজ্য যেখানে SEZ অনুমোদন দিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিকে আকৃষ্ট করছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের এই সিদ্ধান্ত বেশিরভাগ সম্ভাবনাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

পরিণতি—চাকরি ও বৃদ্ধির সম্ভাবনা রুদ্ধ:
রাজ্যের এই নীতির ফলে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা সীমিত হচ্ছে। নতুন কোম্পানি না এলে, বিদ্যমান শ্রমশক্তির জন্য নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হয় না। প্রযুক্তি ও পরিষেবা খাতেও পিছিয়ে পড়ছে রাজ্য, যেখানে ভারতের অন্য রাজ্যগুলো বিশ্বমানের আইটি হাব হয়ে উঠেছে।

পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাহত হওয়ার পেছনে মৌলিক সমস্যা হল নীতি নির্ধারণে দুর্বলতা এবং অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা। নতুন সংস্থা আসতে আগ্রহী নয়, পুরনোগুলিও স্থানান্তর করছে। বিনিয়োগ এবং ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে রাজ্য সরকারকে এখনই কার্যকরী এবং বিনিয়োগবান্ধব নীতি গ্রহণ করতে হবে, নয়তো ভবিষ্যতে রাজ্যের আর্থিক স্থিতি আরও দুর্বল হবে।