পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মচারীরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের বেতন কাঠামোর সংশোধন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ৮ম বেতন কমিশনের (8th Pay Commission) সুপারিশের দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে আসছেন। ২০২৫ সালের জুলাই মাসের শেষে, এই দাবি নিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি কর্মচারী সংগঠন (Bengal Employee Protest) কলকাতার রাজপথে প্রতিবাদে নেমেছে। এই প্রতিবাদের মূল লক্ষ্য হল রাজ্য সরকারের কাছে ৮ম বেতন কমিশনের সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য চাপ সৃষ্টি করা এবং মূল্যস্ফীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বেতনের প্রকৃত মূল্য রক্ষা করা। পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মচারীদের এই আন্দোলন এখন রাজ্যের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
প্রতিবাদের পটভূমি এবং দাবি
পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে সরকারি কর্মচারীদের বেতন কাঠামো ৬ষ্ঠ বেতন কমিশনের অধীনে পরিচালিত হয়, যা কেন্দ্রীয় সরকারের ৭ম বেতন কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছিল। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে এই কমিশন কার্যকর হলেও, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল সরকার মাত্র ৬% মহার্ঘ ভাতা (ডিএ) ঘোষণা করেছে, যা কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের জন্য বর্তমানে ৫৫% ডিএ-এর তুলনায় অনেক কম। এই বৈষম্যের কারণে রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় সরকার ৮ম বেতন কমিশন গঠনের ঘোষণা করে, যা ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই কমিশনের সুপারিশে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের বেতন ৩০-৩৪% বৃদ্ধি পেতে পারে, এবং ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ১.৮৩ থেকে ২.৪৬ এর মধ্যে নির্ধারিত হতে পারে। এই ঘোষণার পর পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মচারীরা দাবি তুলেছেন যে, রাজ্য সরকার তাদের জন্যও একটি নতুন বেতন কমিশন গঠন করুক, যা কেন্দ্রীয় ৮ম সিপিসি-র সুপারিশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
প্রতিবাদের রূপ এবং সংগঠন
জুলাই ২০২৫-এর শেষ সপ্তাহে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারি কর্মচারী সংগঠনের (West Bengal State Government Employees’ Organisation) নেতৃত্বে কলকাতার বিধানসভার সামনে বড় ধরনের প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রতিবাদে হাজার হাজার কর্মচারী অংশ নেন, যারা কেন্দ্রীয় সরকারের সমপরিমাণ মহার্ঘ ভাতা এবং নতুন বেতন কমিশনের দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানান। এই সমাবেশে সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি পেনশনভোগীদের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন, যারা দাবি করেন যে রাজ্যের উচ্চ মূল্যস্ফীতির হারের তুলনায় তাদের বেতন এবং পেনশন অপ্রতুল।
কর্মচারী সংগঠনগুলির দাবি, রাজ্য সরকারের উচিত কেন্দ্রীয় সরকারের ডিএ হারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তাদের বেতন সংশোধন করা। তারা আরও জানিয়েছে যে, ৮ম বেতন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে বিলম্ব হলে তাদের আর্থিক ক্ষতি আরও বাড়বে। একজন প্রতিবাদী কর্মচারী বলেন, “আমরা প্রতিদিন মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাচ্ছি, কিন্তু আমাদের বেতন তা মেটাতে পারছে না। রাজ্য সরকারের উচিত আমাদের ন্যায্য বেতন এবং ভাতা নিশ্চিত করা।”
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া এবং বিতর্ক
এই প্রতিবাদ নিয়ে রাজ্যের রাজনৈতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্ররা জানিয়েছেন যে, রাজ্য সরকার ইতিমধ্যে ৬ষ্ঠ বেতন কমিশন বাস্তবায়ন করেছে এবং রাজ্যের আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে ধীরে ধীরে ডিএ বাড়ানো হচ্ছে। সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবসময় কর্মচারীদের পাশে আছেন। ডিএ বকেয়া পরিশোধের জন্য সঠিক সময়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।” তবে, বিরোধী দলগুলি, বিশেষ করে সিপিআই(এম) এবং বিজেপি, এই ইস্যুতে সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করেছে। সিপিআই(এম) নেতা মহম্মদ সেলিম বলেন, “রাজ্য সরকার কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি উপেক্ষা করছে। এটি তাদের অধিকারের লঙ্ঘন।”
বিজেপি নেতারা দাবি করেছেন যে, তাদের দল ক্ষমতায় এলে কেন্দ্রীয় হারে ডিএ এবং নতুন বেতন কমিশন বাস্তবায়ন করবে। তবে, কর্মচারী সংগঠনগুলি এই প্রতিশ্রুতিকে রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ব্যবহৃত বলে মনে করছে এবং স্পষ্ট সময়সীমার দাবি জানাচ্ছে।
অর্থনৈতিক প্রভাব এবং চ্যালেঞ্জ
৮ম বেতন কমিশনের বাস্তবায়ন পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বেতন বৃদ্ধি রাজ্যের অর্থনৈতিক বোঝা বাড়াতে পারে, যা ইতিমধ্যে ঋণের চাপে রয়েছে। তবে, এটি কর্মচারীদের ব্যয় ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে পারে, যা ভোক্তা বাজারে চাহিদা বাড়াতে পারে।
কর্মচারী সংগঠনগুলি জানিয়েছে যে, তারা আগামী মাসগুলিতে প্রতিবাদ আরও জোরদার করবে যদি সরকার তাদের দাবি পূরণ না করে। তারা একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ৭ম রাজ্য বেতন কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে, যা কেন্দ্রীয় ৮ম সিপিসি-র সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
৮ম বেতন কমিশনের বাস্তবায়নের সময়সীমা এখনও অনিশ্চিত, কারণ এর সুপারিশ ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে জমা দেওয়া হতে পারে এবং বাস্তবায়ন ২০২৭ সালের শুরুতে শুরু হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মচারীরা এই বিলম্বকে আরও অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হিসেবে দেখছেন। তাদের দাবি, রাজ্য সরকারের উচিত এখনই একটি নতুন বেতন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করা।
এই আন্দোলন রাজ্যের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতির উপর নির্ভর করে ভবিষ্যতে আরও তীব্র হতে পারে। কর্মচারীদের ক্ষোভ এবং প্রতিবাদ রাজ্য সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, এবং এর সমাধান কীভাবে হবে, তা দেখার জন্য সকলের দৃষ্টি এখন সরকারের দিকে।