আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতের অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ মাথা তুলেছে। বিশ্ববিখ্যাত আমেরিকান খুচরা বাণিজ্য কোম্পানি ওয়ালমার্ট ইনকর্পোরেটেড (Walmart Inc.) এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার ঘটেছে, যার ফলে ভারত থেকে প্রতি বছর ১০ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৮৩,০০০ কোটি টাকা) আমদানির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তটি ভারতীয় অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশক হিসেবে গৃহীত হচ্ছে, বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি উদ্যোগ (MSME) এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীদের জন্য।
ওয়ালমার্ট ও ফ্লিপকার্টের ভূমিকা
ওয়ালমার্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডগ ম্যাকমিলন (Doug McMillon) এই সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে আলোচনা করে ভারতের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী অংশীদারিত্বের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমরা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা উৎসাহিত এবং ফ্লিপকার্ট ও ফোনপে-র মাধ্যমে উদ্ভাবন ও আমদানিতে বিনিয়োগ করে আমাদের ১০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্য অর্জনের জন্য অংশীদারি করতে গর্বিত।” ফ্লিপকার্ট, যা ওয়ালমার্টের মালিকানাধীন, ভারতের ছোট ও মাঝারি উদ্যোগগুলোকে বিশ্ববাজারে নিয়ে যাওয়ার জন্য ‘সমর্থ’ প্রোগ্রাম চালাচ্ছে। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে বর্তমানে ১৫০,০০০-এরও বেশি ছোট ব্যবসায়ীদের অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আনা হয়েছে, যা ২০২৩ সালের ফিকি (FICCI) প্রতিবেদন অনুযায়ী ই-কমার্সের প্রভাবকে উল্লেখ করে।
MSME-এর ভূমিকা ও আর্থিক প্রভাব
ভারতের ৬৩ মিলিয়ন MSME-এর মধ্যে এই উদ্যোগটি একটি বিপ্লব আনতে পারে। এই ছোট ব্যবসায়ীদের বিশ্ববাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি করে ওয়ালমার্ট ভারতের ‘আত্মনির্ভর ভারত’ অভিযানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করছে। ২০২৪ সালের ফ্লিপকার্টের তথ্য অনুযায়ী, গ্রামীণ এলাকার ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ বর্তমানে ফ্লিপকার্টের বিক্রেতা বেসের ৪৫% নিয়ে নিয়েছে, যা শহরকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ধারণাকে পুনর্নির্ধারণ করে। এছাড়া, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (RBI) একটি গবেষণা অনুযায়ী, ২০২১ থেকে শুরু হওয়া উৎপাদন-সম্পর্কিত প্রণোদনা (PLI) পরিকল্পনাগুলো প্রতি বছর ১৬% উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটিয়েছে, যা চীনের বাইরে বিশ্ববাজারে সরবরাহ শৃঙ্খলা বিবidh করতে সাহায্য করছে।
গ্রামীণ উন্নয়ন ও স্থানীয় শিল্প
এই পরিকল্পনায় গ্রামীণ এলাকার শিল্পক্ষেত্র ও কারিগরদের উন্নয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করছে। ফ্লিপকার্টের ‘সমর্থ’ প্রোগ্রামের মাধ্যমে ৯,৫০,০০০-এরও বেশি কারিগর, তাঁতী এবং ছোট ব্যবসায়ীদের জীবিকা সমর্থন করা হচ্ছে, যা গ্রামীণ উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের ডে-এনআরএলএম (DAY-NRLM) প্রোগ্রামের সঙ্গে যুক্ত। এই সহযোগিতা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ, যেমন কাশ্মীর থেকে কর্ণাটক পর্যন্ত, স্থানীয় শিল্পকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরছে। উদাহরণস্বরূপ, ট্রাইবস ইন্ডিয়া-এর সঙ্গে ফ্লিপকার্টের যৌথ উদ্যোগে আদিবাসী কারিগরদের হস্তশিল্প পণ্যগুলো ৩.৫০ লক্ষ মানুষের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করছে।
সমালোচনা ও চ্যালেঞ্জ
তবে এই উদ্যোগের সঙ্গে কিছু প্রশ্ন ও সমালোচনাও উঠে এসেছে। কিছু ব্যবহারকারী জানিয়েছেন যে গুজরাটের ব্যবসায়ীদের উপর এই পরিকল্পনার প্রভাব বেশি হতে পারে, যা দক্ষিণ ভারতের উদ্যোগী সম্প্রদায় (তামিল, তেলেগু, মালয়ালি ও কন্নড়) বা উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের ব্যবসায়ীদের পেছনে ফেলে দিতে পারে। এছাড়া, ১২ বছর আগে বিজেপি ওয়ালমার্টের বিরোধিতা করেছিল, এখন কী পরিবর্তন হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তবে, বর্তমানে এই সহযোগিতা ভারতের আর্থিক স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
এই ১০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্য অর্জনের জন্য ওয়ালমার্ট কৃষক ও শ্রমিকদের সঙ্গে সরাসরি সহযোগিতা করার পরিকল্পনা করছে, যা তাদের ছোট আকারের উৎপাদনকারী হিসেবে উন্নত করবে। এটি ভারতের অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য ও গ্রামীণ উন্নয়নকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই উদ্যোগটি ভারতকে বিশ্ববাজারে একটি শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে দেবে, যা শুধুমাত্র বোর্ডরুম নয়, গ্রামের আঙিনা ও ছোট দোকানগুলো থেকে শুরু হবে।
সুতরাং, ওয়ালমার্টের এই উদ্যোগ ভারতের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকে গড়ে তুলতে একটি নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে। এটি শুধু ব্যবসায়ীদের জন্য নয়, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায়ও ইতিবাচক পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা রাখে।