মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের আমদানির উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক (US tariff hike) আরোপ করায় আগস্ট মাসে দেশের আর্থিক পরিস্থিতি স্পষ্টতই চাপের মধ্যে পড়েছে। শেয়ারবাজারে বড়সড় ধাক্কা এসেছে, পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগের (FPI) ধারাবাহিক বহির্গমন রূপ নিয়েছে এক গভীর উদ্বেগে। রেটিং সংস্থা ক্রিসিলের প্রকাশিত এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
আর্থিক পরিস্থিতির সূচক নেমে গেল নেতিবাচকে:
ক্রিসিল জানিয়েছে, তাদের ফিনান্সিয়াল কন্ডিশনস ইনডেক্স (FCI) আগস্টে নেমে দাঁড়িয়েছে -০.৫, যা জুলাই মাসের -০.৪ এর তুলনায় আরও নিচে। এই সূচকটি টাকা বাজার, ঋণ বাজার, শেয়ারবাজার এবং বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের চারটি গুরুত্বপূর্ণ পরিমাপককে একত্রিত করে তৈরি হয়।
একটি নিম্নতর মান নির্দেশ করে যে আর্থিক পরিস্থিতি আগের মাসের তুলনায় আরও আঁটসাঁট হয়েছে। আর নেতিবাচক মান মানে পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদি গড়ের চেয়েও কঠিন। যদিও ক্রিসিল জানাচ্ছে, আগস্টের সূচক এখনও এক স্ট্যান্ডার্ড ডিভিয়েশনের মধ্যে রয়েছে, অর্থাৎ পুরোপুরি বিপদসীমা অতিক্রম করেনি।
বিদেশি বিনিয়োগে বড় ধাক্কা:
আগস্ট মাসে বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগকারীদের (FPI) আচরণ ছিল সবচেয়ে উদ্বেগজনক। টানা তৃতীয় মাসেও নিট বহির্গমন দেখা গেছে। বিশেষত শেয়ারবাজার থেকে বিপুল অর্থ প্রত্যাহার করে নিয়েছে এফপিআইরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন শুল্কবৃদ্ধির জেরে এফপিআইয়ের আস্থা নষ্ট হয়েছে। শেয়ারবাজার থেকে নিট বহির্গমন দাঁড়িয়েছে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা জুলাই মাসের ২.১ বিলিয়ন ডলারের প্রায় দ্বিগুণ এবং চলতি বছরের জানুয়ারির পর সর্বোচ্চ।
তবে এর উল্টো চিত্র দেখা গেছে ঋণ বাজারে। আগস্টে এফপিআইরা নিট বিনিয়োগ করেছে ১.৫ বিলিয়ন ডলার, যা জুলাইয়ের ০.৯ বিলিয়ন ডলার থেকে বেশি। এটি গত পাঁচ মাসের সর্বোচ্চ। এর পেছনে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে মার্কিন ট্রেজারি ইল্ড ও অপরিশোধিত তেলের দামের পতন। আগস্টে ১০ বছরের মার্কিন ট্রেজারি ইল্ড গড়ে ১৩ বেসিস পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৪.২৬ শতাংশে।
শেয়ারবাজারে পতন:
শুল্কবৃদ্ধি ও বিনিয়োগ প্রত্যাহারের জেরে শেয়ারবাজারে উল্লেখযোগ্য পতন লক্ষ্য করা গেছে। আগস্ট মাসে গড়ে এসঅ্যান্ডপি বিএসই সেনসেক্স এবং নিফটি ৫০ সূচক যথাক্রমে ২ শতাংশ ও ১.৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
তবে বাজার আরও গভীর পতনে না যাওয়ার পেছনে কিছু ইতিবাচক উপাদানও ভূমিকা রেখেছে। এর মধ্যে রয়েছে—
পণ্য ও পরিষেবা করের (GST) হার পুনর্বিবেচনার প্রস্তাব, ভোগব্যয় বৃদ্ধির প্রত্যাশা এবং আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের পক্ষ থেকে ভারতের সার্বভৌম ক্রেডিট রেটিং উন্নীত করার সম্ভাবনা।
রুপির সর্বকালের রেকর্ড পতন:
বাজারের টালমাটাল পরিস্থিতি মুদ্রাবাজারেও প্রতিফলিত হয়েছে। আগস্টে টানা তৃতীয় মাসের মতো রুপির ওপর চাপ বজায় থেকেছে। মাসিক ভিত্তিতে রুপি ১.৬ শতাংশ দুর্বল হয়েছে এবং ডলারের বিপরীতে গড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৭.৫।
আগস্টের ২৯ তারিখে রুপি ইতিহাসে সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছয়— ১ ডলার = ৮৭.৮ রুপি। এটি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
ঋণ বাজারে চাপ:
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১০ বছরের বেঞ্চমার্ক সরকারি বন্ডের (G-sec) ইল্ড আগস্টে তীব্রভাবে বেড়েছে। এর প্রধান কারণ হলো সরকারের জিএসটি হ্রাসের সিদ্ধান্তের ফলে রাজস্ব ঘাটতির সম্ভাবনা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের দুশ্চিন্তা।
অন্যদিকে মানি মার্কেটের সুদের হারও সামান্য বেড়েছে। কারণ আগস্টে তরল অর্থ সরবরাহের আধিক্য কিছুটা কমে যায়, ফলে বাজারে স্বল্পমেয়াদি তহবিলের খরচ বৃদ্ধি পায়।
ক্রিসিলের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, মার্কিন শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাব ভারতের আর্থিক বাজারে স্পষ্ট।
শেয়ারবাজারে পতন, এফপিআইয়ের বিশাল বহির্গমন, রুপির দুর্বলতা এবং সরকারি বন্ডের ইল্ড বৃদ্ধি—
সব মিলিয়ে আর্থিক পরিস্থিতি কঠিন হয়ে উঠেছে।
তবে সংস্থাটি সতর্ক করেছে যে পরিস্থিতি এখনও বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছায়নি। ভবিষ্যতে ভোগব্যয় বাড়ানো, করনীতির সংস্কার, আন্তর্জাতিক রেটিংয়ে উন্নতি এবং বৈশ্বিক আর্থিক পরিবেশের ইতিবাচক প্রভাব থাকলে বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে।
আগস্ট মাসটি ভারতের আর্থিক বাজারের জন্য নিঃসন্দেহে এক অস্থির সময় ছিল। মার্কিন শুল্কবৃদ্ধি এবং বিদেশি বিনিয়োগের অনিশ্চয়তা দেশের শেয়ারবাজার ও মুদ্রাবাজারকে টালমাটাল করে দিয়েছে। তবে সরকারের নীতিগত পদক্ষেপ, আন্তর্জাতিক আস্থা এবং ভোগব্যয় বৃদ্ধির প্রত্যাশা আগামী দিনে পরিস্থিতি সামাল দিতে কতটা কার্যকর হয়, এখন সেটিই দেখার বিষয়।