যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিশাল পরিসরের নির্ভুল হামলা’ (US Airstrike) ইরানের তিনটি প্রধান পরমাণু স্থাপনায় পরিচালিত হওয়ার পর, আন্তর্জাতিক আকাশপথে ব্যাপক অস্থিরতা ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। এই ঘটনার সরাসরি প্রভাব পড়েছে ভারতের হায়দরাবাদ থেকে লন্ডনগামী ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি নির্ধারিত ফ্লাইটের ওপর, যা রবিবার সকালে সম্পূর্ণ বোর্ডিং শেষ করার পরও প্রায় দুই ঘণ্টা রানওয়েতে আটকে পড়ে।
আকাশসীমা নিষেধাজ্ঞা ও নিরাপত্তা অনুমতির অভাবে উড্ডয়নে বিলম্ব:
শমশাবাদে রাজীব গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সূত্রে জানা যায়, বিমানটি উড্ডয়নের সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেও, মধ্যপ্রাচ্যের আকাশসীমা সংক্রান্ত হঠাৎ জারি হওয়া বিধিনিষেধ ও নতুন সামরিক সংঘাতের জেরে ফ্লাইটটির প্রয়োজনীয় অনুমতি তখনও মেলেনি। এয়ারলাইন সূত্রে জানা যায়, “মধ্যপ্রাচ্যের আকাশপথ বর্তমানে চরম অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ফলে, নিরাপত্তাজনিত অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত ফ্লাইট ছাড়ার অনুমতি নেই।”
ট্রাম্পের ভাষণ: ‘সফল সামরিক অভিযান’, ইরানের পরমাণু স্থাপনা ধ্বংস:
এই ঘটনার কিছুক্ষণ আগেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে ঘোষণা করেন যে, ইরানের ফোর্ডো, নাটাঞ্জ ও ইসফাহান পরমাণু স্থাপনাগুলোর ওপর মার্কিন সামরিক বাহিনী সফলভাবে ‘ভয়াবহ নির্ভুল হামলা’ চালিয়েছে। তিনি এ হামলাকে ‘চূড়ান্ত সামরিক সাফল্য’ বলে আখ্যায়িত করেন।
ট্রাম্প বলেন, “এই পরমাণু স্থাপনাগুলো নির্মাণ করে ইরান একটি ভয়ঙ্কর ধ্বংসযজ্ঞের পথে পা বাড়িয়েছিল। আমরা তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেছি। এখন ইরানকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে— শান্তি না কি আরও বড় ট্র্যাজেডি।”
ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় ও আগাম হুঁশিয়ারি:
হোয়াইট হাউস থেকে দেওয়া ওই ভাষণে ট্রাম্প ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং বলেন, “আমরা এমনভাবে একসাথে কাজ করেছি, যেটা আগে কোনো দেশ কখনও করেনি।” উপ-রাষ্ট্রপতি জেডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পিট হেগসেথ তার পাশে উপস্থিত ছিলেন।
ট্রাম্প ইরানকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের দুর্বৃত্ত’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, “ইরান ৪০ বছর ধরে আমেরিকা ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়েছে। তারা আমাদের সৈন্যদের হাত-পা উড়িয়ে দিয়েছে বোমা ফাটিয়ে। আমরা আর সহ্য করব না।”
পরিস্থিতির তাৎক্ষণিক প্রভাব: আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ও আকাশপথে ঝুঁকি:
মধ্যপ্রাচ্যের আকাশপথ মূলত ইউরোপ-এশিয়া সংযোগকারী আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ করিডর। ইরানের ওপর হামলার জেরে এই আকাশপথে নিরাপত্তা হুমকি এবং আঞ্চলিক যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ায় একাধিক দেশ আকাশসীমা ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এ অবস্থায় অনেক আন্তর্জাতিক ফ্লাইটকে বিকল্প রুট নিতে বাধ্য করা হচ্ছে, ফলে সময় ও ব্যয় দুই-ই বেড়ে যাচ্ছে।
হায়দরাবাদ-লন্ডন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ ফ্লাইটের যাত্রীদের একাংশ জানান, তারা আতঙ্কিত ও হতাশ। “সকাল থেকেই আমরা প্লেনে ছিলাম, হঠাৎ জানানো হয় উড্ডয়ন স্থগিত। ছোটো বাচ্চা নিয়ে এই অবস্থায় দুই ঘণ্টা বসে থাকা সত্যিই কষ্টকর,” বলেন এক যাত্রী।
বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া: আতঙ্ক ও কূটনৈতিক উদ্বেগ:
ইরানের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না এলেও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহল আশঙ্কা প্রকাশ করছে যে, এ ধরনের সরাসরি হামলা মধ্যপ্রাচ্যে আরও একটি যুদ্ধের দ্বার খুলে দিতে পারে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং রাশিয়ার মতো শক্তিগুলো সংযম ও কূটনৈতিক সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, “এই হামলা শুধু সামরিকভাবে নয়, বিশ্ব অর্থনীতি, জ্বালানি বাজার এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর গভীর প্রভাব ফেলবে।”
যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে চলমান উত্তেজনার নতুন মোড় আন্তর্জাতিক শান্তির জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, বিশেষত যারা আন্তর্জাতিক ভ্রমণে রয়েছেন। ভারতীয় বিমান সংস্থাগুলোও পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছে, এবং প্রয়োজনে মধ্যপ্রাচ্য অভিমুখী ফ্লাইট রুট পরিবর্তনের চিন্তা করছে।
ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ হায়দরাবাদ-লন্ডন ফ্লাইটের অবস্থা শেষ পর্যন্ত কী হয়, তা এখন নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পরিস্থিতি ও আকাশসীমার নতুন নির্দেশনার ওপর। তবে এই ঘটনা একটি ইঙ্গিত— বৈশ্বিক সংঘাত কেবল যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে।