অয়ন দে, আলিপুরদুয়ার: ভরা চা মরশুমে হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে আলিপুরদুয়ার জেলার তুরতুরি চা বাগান (Turuturi Tea Estate Shuts Down)। শুক্রবার গভীর রাতে কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই বাগানের মালিকপক্ষ প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করে চলে যায়, যা ৫০১ শ্রমিক পরিবারের জন্য একটি মর্মান্তিক ধাক্কা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শনিবার সকালে নিয়মমাফিক কাজে যোগ দিতে এসে শ্রমিকরা বাগানের প্রধান দরজায় ঝোলানো “Suspension of Work” নোটিশ দেখে হতবাক হয়ে পড়েন। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় বাগান চত্বরে এখন হতাশা, ক্ষোভ এবং অনিশ্চয়তার ছায়া। চা পাতা তোলার মৌসুমের শীর্ষে এই বন্ধের ঘোষণা শ্রমিকদের জীবিকার উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।
ঘটনার পটভূমি
তুরতুরি চা বাগান আলিপুরদুয়ার ২ নম্বর ব্লকে অবস্থিত এবং এখানে ৫০১ জন শ্রমিক কাজ করেন। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে শ্রমিকদের মজুরি প্রদানে বিলম্বের সমস্যা চলছিল। দুই পাক্ষিকের মজুরি বকেয়া থাকা সত্ত্বেও মালিকপক্ষ এই বিষয়ে কোনো সমাধানের উদ্যোগ নেয়নি। শ্রমিকরা জানান, মালিকপক্ষের কাছে বারবার মজুরি পরিশোধের দাবি জানানো হলেও কোনো সাড়া মেলেনি। ফলে, শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছিল। এই পরিস্থিতিতে শুক্রবার রাতে মালিকপক্ষ নীরবে বাগান ত্যাগ করে, এবং পরদিন সকালে নোটিশ টাঙিয়ে কাজ বন্ধের ঘোষণা দেয়।
শ্রমিকদের প্রতিক্রিয়া
চা মরশুমের মাঝে এমন সিদ্ধান্তে শ্রমিকরা হতাশ এবং ক্ষুব্ধ। এক শ্রমিক বলেন, “আমরা প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করে চা পাতা তুলছি। কিন্তু মজুরি না পাওয়ায় আমাদের পরিবার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এখন বাগান বন্ধ হওয়ায় আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।” তৃণমূল চা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি বীরেন্দ্র বারা জানান, শ্রমিকরা তাদের প্রাপ্য মজুরির দাবিতে কাজে যোগ দিতে অনীহা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেন, “শ্রমিকদের দাবি ন্যায্য। আমরা মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করেছি, কিন্তু তারা কোনো সমাধান না করে বাগান বন্ধ করে দিয়েছে।” তিনি আরও বলেন, এই মৌসুমে কাজ বন্ধ হওয়া বাগানের জন্যও ক্ষতিকর।
মালিকপক্ষের বক্তব্য
তুরতুরি চা বাগানের ডেপুটি ম্যানেজার প্রান্তিক সরকার দাবি করেছেন, শুধুমাত্র এক পাক্ষিকের মজুরি বকেয়া রয়েছে। তিনি বলেন, “আমরা শীঘ্রই বকেয়া মজুরি পরিশোধের চেষ্টা করছি। শ্রমিকদের উচিত এই সময়ে সহযোগিতা করা, কারণ মরশুমের শুরুতে কাজ বন্ধ হলে বাগানের ক্ষতি হবে।” তবে, শ্রমিকরা এই দাবি মানতে নারাজ, তাঁদের বক্তব্য, দুই পাক্ষিকের মজুরি এখনও বকেয়া।
চা শিল্পের সংকট
উত্তরবঙ্গের চা শিল্প দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশনের (আইটিএ) তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে চায়ের দাম বছরে গড়ে ৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে উৎপাদন খরচ, যেমন কয়লা, গ্যাস, সার এবং কীটনাশকের দাম ৯ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বেড়েছে। এছাড়া, শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি গত পাঁচ বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই আর্থিক চাপের কারণে অনেক চা বাগান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বা পরিচালনা ব্যয় মেটাতে অক্ষম হচ্ছে। তুরতুরি চা বাগানের ঘটনা এই সংকটের একটি প্রতিফলন।
প্রশাসনের ভূমিকা
ঘটনার পর জেলা প্রশাসন এবং শ্রম দপ্তর বাগানে পৌঁছে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেছে। তবে, বাগান পুনরায় চালু করা বা শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধের বিষয়ে এখনও কোনো স্পষ্ট সমাধান দেওয়া হয়নি। শ্রম দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, “আমরা মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। শীঘ্রই একটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে।” তবে, শ্রমিকরা বলছেন, এই ধরনের বৈঠকে মালিকপক্ষ প্রায়ই অনুপস্থিত থাকে, যা সমস্যাকে আরও জটিল করে।
শ্রমিকদের দাবি
শ্রমিকরা তাদের বকেয়া মজুরি এবং বাগানের পুনরায় চালুর দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, চা মরশুমে এই বন্ধ তাঁদের পরিবারের জীবিকার উপর গভীর প্রভাব ফেলবে। এক শ্রমিক, সুমিত্রা ওঁরাও, বলেন, “আমাদের পরিবার চা বাগানের উপর নির্ভরশীল। এখন কাজ বন্ধ হলে আমরা খাব কী?” তৃণমূল চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা বলছেন, শ্রম দপ্তরের উচিত মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া এবং শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা।
তুরতুরি চা বাগানের এই অপ্রত্যাশিত বন্ধ উত্তরবঙ্গের চা শিল্পের চলমান সংকটকে আরও স্পষ্ট করেছে। ৫০১ শ্রমিক পরিবার এখন অন্ধকারে দিন গুনছে। মালিকপক্ষের গা-ঢাকা দেওয়া এবং মজুরি বকেয়ার সমস্যা শ্রমিকদের জীবনে অনিশ্চয়তা এনেছে। প্রশাসন এবং শ্রম দপ্তরের দ্রুত হস্তক্ষেপ এখন সময়ের দাবি। তুরতুরি চা বাগানের এই ঘটনা শুধু শ্রমিকদের জীবিকার সংকটই নয়, বরং উত্তরবঙ্গের চা শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর প্রশ্ন তুলেছে।