শিক্ষার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের এই যুগে, শিক্ষা ঋণ (Education Loan) শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ভারত সরকার এবং বিভিন্ন ব্যাঙ্ক ২০২৫ সালে শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ কিস্তিতে শিক্ষা ঋণ প্রদানের জন্য একাধিক প্রকল্প চালু করেছে। এই প্রকল্পগুলি শুধুমাত্র টিউশন ফি নয়, বরং থাকার খরচ, বই, ভ্রমণ এবং অন্যান্য শিক্ষা-সংক্রান্ত ব্যয়ও কভার করে। সরকারি ভর্তুকি, কম সুদের হার, এবং নমনীয় পরিশোধের বিকল্প সহ এই ঋণগুলি শিক্ষার্থীদের আর্থিক বোঝা কমাতে সাহায্য করছে। এই প্রতিবেদনে আমরা ২০২৫ সালের সেরা শিক্ষা ঋণ প্রকল্পগুলির বিশদ বিবরণ তুলে ধরব।
প্রধানমন্ত্রী বিদ্যালক্ষ্মী যোজনা
ভারত সরকারের ‘প্রধানমন্ত্রী বিদ্যালক্ষ্মী যোজনা’ শিক্ষার্থীদের জন্য একটি যুগান্তকারী প্রকল্প। এই প্রকল্পের অধীনে, মেধাবী শিক্ষার্থীরা দেশের শীর্ষ ৮৬০টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য জামানতবিহীন এবং গ্যারান্টারবিহীন ঋণ পেতে পারেন। এই ঋণ টিউশন ফি, হোস্টেল খরচ, এবং অন্যান্য শিক্ষা-সংক্রান্ত ব্যয় কভার করে। প্রকল্পটি সম্পূর্ণ ডিজিটাল আবেদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যা বিদ্যালক্ষ্মী পোর্টাল (https://pmvidyalaxmi.co.in) থেকে অ্যাক্সেস করা যায়। বার্ষিক পরিবারের আয় ৮ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হলে, শিক্ষার্থীরা ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণের উপর ৩% সুদ ভর্তুকি পান। এই প্রকল্পের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল এর দীর্ঘ পরিশোধের মেয়াদ, যা সাধারণত ১৫ বছর পর্যন্ত হতে পারে, ফলে মাসিক কিস্তি (EMI) সাশ্রয়ী হয়।
কেন্দ্রীয় খাতের সুদ ভর্তুকি প্রকল্প (CSIS)
কেন্দ্রীয় খাতের সুদ ভর্তুকি প্রকল্প (Central Sector Interest Subsidy Scheme) ২০০৯ সাল থেকে কার্যকর রয়েছে। এই প্রকল্পে বার্ষিক পরিবারের আয় ৪.৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত হলে, শিক্ষার্থীরা মোরাটোরিয়াম পিরিয়ড (কোর্সের সময়কাল + ১ বছর) পর্যন্ত সম্পূর্ণ সুদ ভর্তুকি পান। এই প্রকল্পটি NAAC, NBA, বা কেন্দ্রীয় তহবিলপ্রাপ্ত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে (CFTIs) পেশাদার বা প্রযুক্তিগত কোর্সের জন্য প্রযোজ্য। ঋণের সর্বোচ্চ সীমা ১০ লক্ষ টাকা। ক্যানারা ব্যাঙ্ক এই প্রকল্পের নোডাল ব্যাঙ্ক হিসেবে কাজ করে। এই প্রকল্পের সুবিধা হল, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সময় সুদের বোঝা বহন করতে হয় না, যা তাদের আর্থিক চাপ কমায় এবং সহজ কিস্তিতে ঋণ পরিশোধের সুযোগ দেয়।
ক্রেডিট গ্যারান্টি ফান্ড স্কিম ফর এডুকেশন লোন (CGFSEL)
২০১৫ সালে চালু হওয়া ক্রেডিট গ্যারান্টি ফান্ড স্কিম ফর এডুকেশন লোন (CGFSEL) শিক্ষার্থীদের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। এই প্রকল্পের অধীনে, ৭.৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণের জন্য কোনো জামানত বা তৃতীয় পক্ষের গ্যারান্টির প্রয়োজন হয় না। জাতীয় ক্রেডিট গ্যারান্টি ট্রাস্টি কোম্পানি লিমিটেড (NCGTC) এই প্রকল্পের গ্যারান্টি প্রদান করে, যা ব্যাঙ্কগুলিকে ঝুঁকি কমিয়ে ঋণ প্রদানে উৎসাহিত করে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সহজ শর্তে ঋণ পান এবং দীর্ঘ মেয়াদে কিস্তিতে পরিশোধ করতে পারেন।
শীর্ষ ব্যাঙ্কের শিক্ষা ঋণ প্রকল্প
২০২৫ সালে বেশ কিছু ব্যাঙ্ক শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ কিস্তির শিক্ষা ঋণ প্রকল্প অফার করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু প্রকল্প হল:
• স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (SBI): SBI-এর শিক্ষা ঋণ স্কিমে ৭.৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণের জন্য কোনো জামানতের প্রয়োজন হয় না। সুদের হার ৮.১৫% থেকে শুরু হয়, এবং পরিশোধের মেয়াদ ১৫ বছর পর্যন্ত। মেয়ে শিক্ষার্থী এবং মেধাবীদের জন্য ০.৫০% পর্যন্ত সুদে ছাড় দেওয়া হয়। মোরাটোরিয়াম পিরিয়ডে সুদ পরিশোধ করলে সুদের হার আরও কমানো যায়।
• ব্যাঙ্ক অফ বরোদা: এই ব্যাঙ্কে ১৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত শিক্ষা ঋণ পাওয়া যায়, বিশেষ করে প্রিমিয়ার ইনস্টিটিউটে পড়াশোনার জন্য। সুদের হার ৭% থেকে ১৩% এর মধ্যে থাকে, এবং কোনো প্রসেসিং ফি লাগে না। শিক্ষার্থীরা বিদ্যালক্ষ্মী পোর্টালের মাধ্যমে আবেদন করতে পারেন।
• ক্যানারা ব্যাঙ্ক: ক্যানারা ব্যাঙ্কের IBA মডেল শিক্ষা ঋণ প্রকল্পে ৭.৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ জামানতবিহীন। সুদের হার প্রতিযোগিতামূলক, এবং দ্রুত প্রক্রিয়াকরণ এবং বিতরণের সুবিধা রয়েছে। এই ব্যাঙ্ক CSIS প্রকল্পের নোডাল ব্যাঙ্ক হিসেবে কাজ করে।
• ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া: এই ব্যাঙ্কের শিক্ষা ঋণ প্রকল্পে সহজ অনলাইন আবেদন এবং নমনীয় কিস্তির সুবিধা রয়েছে। প্রিমিয়ার ইনস্টিটিউটের জন্য ৪০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জামানতবিহীন ঋণ পাওয়া যায়।
বিদ্যালক্ষ্মী পোর্টাল
বিদ্যালক্ষ্মী পোর্টাল শিক্ষার্থীদের জন্য একটি একক প্ল্যাটফর্ম, যেখানে তারা একটি ফর্ম (CELAF) পূরণ করে একাধিক ব্যাঙ্কে ঋণের জন্য আবেদন করতে পারেন। ৩৮টি ব্যাঙ্ক এই পোর্টালে ৭০টি শিক্ষা ঋণ প্রকল্প নিয়ে যুক্ত রয়েছে। শিক্ষার্থীরা এই পোর্টালের মাধ্যমে তাদের প্রয়োজন এবং যোগ্যতা অনুযায়ী ঋণ বেছে নিতে পারেন। এটি আবেদন প্রক্রিয়াকে সহজ এবং স্বচ্ছ করে।
সুবিধা এবং চ্যালেঞ্জ
শিক্ষা ঋণ প্রকল্পগুলির প্রধান সুবিধা হল:
• দীর্ঘ পরিশোধের মেয়াদ: বেশিরভাগ ঋণে ১৫ বছর পর্যন্ত পরিশোধের সময় দেওয়া হয়, যা কিস্তির পরিমাণ কমায়।
• জামানতবিহীন ঋণ: ৭.৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণের জন্য কোনো জামানতের প্রয়োজন হয় না।
• সুদ ভর্তুকি: CSIS এবং PM বিদ্যালক্ষ্মী প্রকল্পে সুদ ভর্তুকি শিক্ষার্থীদের বোঝা কমায়।
• কর ছাড়: আয়কর আইনের ধারা ৮০ই-এর অধীনে ঋণের সুদের অংশে ৮ বছর পর্যন্ত কর ছাড় পাওয়া যায়।
তবে, কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে:
• যোগ্যতার মানদণ্ড: শিক্ষার্থীদের অবশ্যই স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে হবে এবং ভালো একাডেমিক রেকর্ড থাকতে হবে।
• আর্থিক নথি: আয়ের প্রমাণ এবং কেওয়াইসি নথি জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক।
• উচ্চ সুদের হার: জামানতবিহীন ঋণে কখনো কখনো সুদের হার বেশি হতে পারে।
প্রতিক্রিয়া
এক্স-এ পোস্ট অনুযায়ী, শিক্ষার্থীরা এই প্রকল্পগুলির জন্য উৎসাহী। একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, “প্রধানমন্ত্রী বিদ্যালক্ষ্মী যোজনা আমার স্বপ্নের কলেজে পড়ার সুযোগ দিয়েছে।” তবে, কিছু শিক্ষার্থী আবেদন প্রক্রিয়ার জটিলতা নিয়ে অভিযোগ করেছেন।
২০২৫ সালে শিক্ষা ঋণ প্রকল্পগুলি শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ এবং সাশ্রয়ী কিস্তির মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার পথ প্রশস্ত করছে। প্রধানমন্ত্রী বিদ্যালক্ষ্মী, CSIS, এবং CGFSEL-এর মতো প্রকল্পগুলি জামানতবিহীন ঋণ এবং সুদ ভর্তুকির মাধ্যমে আর্থিক বাধা দূর করছে। SBI, ব্যাঙ্ক অফ বরোদা, এবং ক্যানারা ব্যাঙ্কের মতো ব্যাঙ্কগুলি নমনীয় পরিশোধের বিকল্প অফার করছে। শিক্ষার্থীদের উচিত বিদ্যালক্ষ্মী পোর্টাল ব্যবহার করে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সেরা প্রকল্প বেছে নেওয়া এবং সময়মতো আবেদন করা। এই প্রকল্পগুলি শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন পূরণের পথে একটি শক্তিশালী ভিত্তি প্রদান করছে।