তিক্ত সত্য! সারের কালোবাজারী কি ভারতের ক্ষুদ্র কৃষকদের ধ্বংস করছে?

ভারতের কৃষি খাতে সারের কালোবাজারী এবং জালিয়াতি (Fertilizer Black Market) একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করছে। ভারতের মোট…

How Fertilizer Black Markets Are Devastating India’s Small Farmers in 2025

ভারতের কৃষি খাতে সারের কালোবাজারী এবং জালিয়াতি (Fertilizer Black Market) একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করছে। ভারতের মোট কৃষক জনসংখ্যার প্রায় ৮৬.২% ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক, যারা ২ হেক্টরের কম জমিতে চাষ করে। এই কৃষকরা সরকারের ভর্তুকিযুক্ত সারের উপর নির্ভরশীল, কিন্তু সারের ঘাটতি এবং কালোবাজারী তাদের ফসল উৎপাদন ও আয়ের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে ২০২১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত, সারের কালোবাজারী এবং জাল সারের ব্যবহার কৃষকদের জন্য একটি মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠেছে। এই নিবন্ধে আমরা এই সমস্যার গভীরতা, এর কারণ, এবং ক্ষুদ্র কৃষকদের উপর এর প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

সারের কালোবাজারী: একটি ক্রমবর্ধমান সংকট
ভারতের কৃষি খাতে সারের চাহিদা বিশাল, বিশেষ করে ইউরিয়া, ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি), এবং পটাশের মতো রাসায়নিক সারের। সরকার কৃষকদের জন্য সারের দাম সাশ্রয়ী রাখতে ভর্তুকি প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপ, একটি ৪৫ কেজি ইউরিয়ার ব্যাগের আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য প্রায় ২,৫০০ টাকা হলেও, ভারতে এটি মাত্র ২৬৬ টাকায় বিক্রি হয়। ডিএপি-এর ক্ষেত্রেও, আন্তর্জাতিক বাজারে ৩,৩৭৫ টাকার একটি ব্যাগ ভারতে ১,৩৫০ টাকায় পাওয়া যায়। এই বিশাল ভর্তুকির ফলে সারের কালোবাজারী এবং অবৈধ বিক্রি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১ সালে, বিশ্বব্যাপী সার সংকটের কারণে ভারতে ইউরিয়া ও ডিএপি-এর ঘাটতি দেখা দেয়, যার ফলে কৃষকরা কালোবাজারে ১,৫০০ টাকায় ডিএপি এবং ৪০০ টাকায় ইউরিয়ার ব্যাগ কিনতে বাধ্য হয়েছেন।

   

কৃষকরা জানিয়েছেন, তারা হয় সারের ব্যবহার কমিয়ে ফসলের উৎপাদন হ্রাসের ঝুঁকি নেবেন, নয়তো কালোবাজারে উচ্চ মূল্যে সার কিনবেন। মধ্যপ্রদেশের গম ও পেঁয়াজ চাষি দিলীপ পাটিদার বলেন, “যদি আমি সময়মতো পর্যাপ্ত সার না পাই, তবে আমার উৎপাদন কমে যাবে।” হরিয়ানার কৃষক সুক্রাম পাল জানিয়েছেন, তিনি স্বাভাবিকের অর্ধেক ডিএপি ব্যবহার করে গম বপন করেছেন, কিন্তু ইউরিয়ার ঘাটতির কারণে উৎপাদন কমার আশঙ্কা রয়েছে।

জাল সার ও প্রতারণার জাল
সারের কালোবাজারীর পাশাপাশি, জাল সারের সমস্যা কৃষকদের জন্য আরেকটি বড় হুমকি। ২০২৫ সালের জুলাই মাসে, একটি এক্স পোস্টে উল্লেখ করা হয়েছে, নকল সার, বীজ এবং কীটনাশকের কারণে ছয়টি গ্রামের ফসল নষ্ট হয়েছে। এই পোস্টে দাবি করা হয়েছে, নকল সার ও ওষুধ বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে কোনও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, যা কৃষকদের পিঠ ভেঙে দিচ্ছে। এছাড়া, ভারতের বৃহত্তম সার প্রস্তুতকারক সংস্থা ইন্ডিয়ান ফার্মার্স ফার্টিলাইজার কো-অপারেটিভ (ইফকো)-এর ন্যানো ইউরিয়া নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। ২০২২ সালে চালু হওয়া এই ন্যানো ইউরিয়া দাবি করে, ২০ গ্রাম ন্যানো ইউরিয়া একটি ৪৫ কেজি ইউরিয়া ব্যাগের সমতুল্য। তবে, গবেষণায় দেখা গেছে, এই পণ্যের কার্যকারিতা নিয়ে পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। প্রতি কিলোগ্রাম নাইট্রোজেনের জন্য ন্যানো ইউরিয়ার দাম প্রচলিত ইউরিয়ার তুলনায় ১০৪৫ গুণ বেশি, যা কৃষকদের জন্য ব্যয়বহুল।

ক্ষুদ্র কৃষকদের উপর প্রভাব
ভারতের কৃষি খাতে ৮০% এর বেশি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক, যারা সীমিত সম্পদ ও জমির উপর নির্ভরশীল। সারের কালোবাজারী এবং জাল সারের কারণে তাদের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা তাদের আয় ও জীবনযাত্রার মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ২০২১ সালে, মধ্যপ্রদেশে ডিএপি-এর ঘাটতির কারণে কৃষকরা গুদাম থেকে সার লুট করতে বাধ্য হয়েছিল। হরিয়ানায়, ২০২৪ সালের অক্টোবরে ডিএপি-এর ৩৮% ঘাটতি রেকর্ড করা হয়, যা কৃষকদের কালোবাজারের উপর নির্ভর করতে বাধ্য করেছে। এই ঘাটতি এবং উচ্চ মূল্য কৃষকদের ফসলের উৎপাদনশীলতা হ্রাস করছে, যা খাদ্য মূল্যস্ফীতি এবং ক্ষুধার সমস্যাকে আরও তীব্র করতে পারে।

সরকারি পদক্ষেপ ও চ্যালেঞ্জ
ভারত সরকার সারের কালোবাজারী রোধে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০২৩ সালে, ফার্টিলাইজার ফ্লাইং স্কোয়াড (এফএফএস) গঠন করা হয়, যারা ১৫টি রাজ্যে ৩৭০টিরও বেশি অভিযান চালিয়ে ৭০,০০০ ব্যাগ ইউরিয়া জব্দ করেছে। এছাড়া, প্রিভেনশন অফ ব্ল্যাক মার্কেটিং অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স অফ সাপ্লাইজ অ্যাক্ট (পিবিএম) এবং এসেনশিয়াল কমোডিটিজ অ্যাক্ট (ইসি অ্যাক্ট)-এর অধীনে ১১ জনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তবে, অর্থনীতিবিদ বিকাশ রাওয়ালের মতে, সরকারের দাবি সত্ত্বেও সারের ঘাটতি অব্যাহত রয়েছে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে, ডিএপি-এর উপলব্ধতা ২০১৯ সালের তুলনায় ৫৫% কম ছিল।

Advertisements

সরকার নিউট্রিয়েন্ট-বেসড সাবসিডি (এনবিএস) প্রকল্পের মাধ্যমে সারের দাম সাশ্রয়ী রাখার চেষ্টা করছে, তবে ইউরিয়াকে এই প্রকল্পের বাইরে রাখা হয়েছে, যার ফলে এর অতিরিক্ত ব্যবহার এবং কালোবাজারী বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া, আমদানি নির্ভরতা (২৫% ইউরিয়া, ৯৫% ফসফেট, এবং ১০০% পটাশ) ভারতের কৃষি খাতকে আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠানামার কাছে দুর্বল করে তুলেছে।

পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব
সারের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং কালোবাজারী শুধুমাত্র কৃষকদের আর্থিক ক্ষতিই করছে না, বরং পরিবেশের উপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। অতিরিক্ত ইউরিয়া ব্যবহার মাটির উর্বরতা হ্রাস, নাইট্রাস অক্সাইড নির্গমন বৃদ্ধি, এবং জলাশয়ে নাইট্রেট দূষণের কারণ হচ্ছে। এই পরিবেশগত ক্ষতি দীর্ঘমেয়াদে ফসলের উৎপাদনশীলতা হ্রাস করছে, যা ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য আরও বড় সংকট সৃষ্টি করছে। সামাজিকভাবে, সারের ঘাটতি এবং কালোবাজারী কৃষকদের মধ্যে হতাশা বাড়াচ্ছে। হরিয়ানায়, ডিএপি-এর জন্য ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর একজন কৃষকের আত্মহত্যা প্রতিবাদের সূত্রপাত করেছে।

সমাধানের পথ
সারের কালোবাজারী ও জালিয়াতি রোধে সরকারকে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, ইউরিয়াকে এনবিএস প্রকল্পের আওতায় আনা এবং ফসফেট ও পটাশ সারের ভর্তুকি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং জৈব সার ও টেকসই কৃষি পদ্ধতির প্রচার করা উচিত। তৃতীয়ত, সার বিতরণ ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজ করা এবং ফার্টিলাইজার ফ্লাইং স্কোয়াডের কার্যক্রম বাড়ানো জরুরি। অবশেষে, কৃষকদের সরাসরি ভর্তুকি প্রদান এবং স্থানীয় স্তরে গ্রামীণ হাটের উন্নয়ন কালোবাজারীর প্রভাব কমাতে পারে।

সারের কালোবাজারী এবং জালিয়াতি ভারতের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য একটি গুরুতর সংকট। এটি তাদের আর্থিক ক্ষতি, ফসলের উৎপাদনশীলতা হ্রাস এবং পরিবেশগত ক্ষতির কারণ হচ্ছে। সরকারি পদক্ষেপ এবং কৃষকদের সচেতনতার মাধ্যমে এই সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব, তবে এর জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। কৃষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে এবং ভারতের কৃষি খাতকে টেকসই করতে সারের কালোবাজারী রোধ এখন সময়ের দাবি।