ভারতের বস্ত্রশিল্প (Textile) ভয়াবহ চাপে পড়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করায় রপ্তানিকারকরা কার্যত নাজেহাল অবস্থায়। ইমকাই রিসার্চের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—এমন মাত্রার শুল্কভার এত সহজে শোষণ করা সম্ভব নয়। শিল্পমহল মনে করছে, পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের জরুরি হস্তক্ষেপ ও আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ অপরিহার্য।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ২ এপ্রিল, ২০২৫-এ যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে ১০ শতাংশ ‘বেসলাইন ট্যারিফ’ আরোপ করে। তখনও রপ্তানিকারক ও ক্রেতারা সমানভাবে অতিরিক্ত খরচ ভাগ করে নিয়ে মার্জিন ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এর পর থেকে ধারাবাহিক হারে শুল্ক বেড়ে এখন প্রায় ৫০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ফলে, ইতিমধ্যেই ক্ষীণ হয়ে আসা মুনাফার মার্জিন কার্যত নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে।
এই উচ্চ শুল্কের প্রভাবে শিল্পে মজুত পণ্যের চাপ (ইনভেন্টরি ওভারহ্যাং) তৈরি হয়েছে। মার্কিন বাজারে বিক্রি আটকে থাকায় ঋণনির্ভর ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা (MSME) সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
বড় রপ্তানিকারকরা তুলনামূলকভাবে আর্থিকভাবে শক্তিশালী হলেও MSME খাতের প্রতিষ্ঠানগুলির হাতে এমন কোনো সঞ্চিত মূলধন নেই। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে হঠাৎ ধাক্কা সামলানোর মতো স্থিতিশীলতা তাদের নেই। ফলে সাম্প্রতিক শুল্কভার তাদের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকারের সহায়তা ছাড়া এই শিল্প টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। বস্ত্রশিল্পের (Textile) মোট দেশীয় উৎপাদনে অবদান ও কর্মসংস্থানের পরিমাণ বিবেচনায় নিলে, দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে তা দেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে।
ভারতের বৈশ্বিক টেক্সটাইল মার্কেট শেয়ার বর্তমানে প্রায় ৪ শতাংশ। এর বিপরীতে বাংলাদেশ ১৩ শতাংশ আর ভিয়েতনাম ৯ শতাংশ দখল করে রেখেছে। তুলনামূলকভাবে কম খরচে উৎপাদন এবং একাধিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সুফল পেয়ে এই দেশগুলো এগিয়ে গেছে। ভারতের ক্ষেত্রে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি কার্যকর হলেও বাস্তবায়নে নানা প্রশাসনিক জটিলতা ও সময়ক্ষেপণের কারণে সুবিধা দ্রুত পাওয়া যাচ্ছে না।
বিশেষত তিরুপ্পুর ক্লাস্টার, যা ভারতের মোট নিটওয়্যার রপ্তানির প্রায় ৫৫–৬০ শতাংশ বহন করে, ভয়াবহ সংকটে পড়েছে। প্রায় ৭০০ বিলিয়ন টাকার বাজারমূল্যবিশিষ্ট এই ক্লাস্টার থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির বড় অংশ স্থগিত হয়ে গেছে। নতুন শুল্ক চাপার পর থেকেই প্রায় ৪০ বিলিয়ন টাকার পণ্য আটকে আছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মার্কিন খুচরা বিক্রেতাদের বিলম্বিত অর্থপ্রদান এবং মৌসুমি মজুত ঝুঁকি, যা পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করেছে।
অবশ্য সরকার কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন—২,৫০০ টাকার নিচের পোশাকে জিএসটি ১২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। একইসঙ্গে তুলা আমদানিতে ১১ শতাংশ শুল্ক মওকুফ করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপ মাঝারি থেকে দীর্ঘমেয়াদে শিল্পকে কিছুটা স্বস্তি দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। কিন্তু প্রতিবেদন অনুযায়ী, এগুলি বর্তমান সঙ্কট সমাধানে যথেষ্ট নয়।
প্রতিবেদনটির মূল বক্তব্য হলো—বর্তমান শুল্কচাপ সামলাতে বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা ও সহায়ক নীতি প্রয়োজন। স্বল্পমেয়াদে নগদ ভর্তুকি, রপ্তানি প্রণোদনা, সুদ সহায়তা, এবং করছাড়ের মতো পদক্ষেপ জরুরি। অন্যথায় ভারত বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে তার অবস্থান ধরে রাখতে পারবে না।
দীর্ঘমেয়াদে কিছু ইতিবাচক দিকও আছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে, যা রপ্তানি ধাক্কার কিছুটা ক্ষতি পূরণ করতে পারে। একই সঙ্গে চলমান একাধিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি কার্যকর হলে নতুন বাজারে প্রবেশ সহজ হবে। শিল্পে কাঠামোগত সংস্কারও দীর্ঘমেয়াদে সহায়ক হবে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়—কবে নাগাদ এই সুফল বাস্তবে পাওয়া যাবে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভারতের বস্ত্রশিল্প (Textile) একটি দ্বিধাবিভক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে। একদিকে মার্কিন বাজারে উচ্চ শুল্কের ধাক্কায় রপ্তানি মুখ থুবড়ে পড়ছে, অন্যদিকে দেশীয় চাহিদা ও সম্ভাব্য সংস্কারকে ঘিরে আশার আলো জ্বলছে। ইমকাই রিসার্চের প্রতিবেদন স্পষ্ট করেছে যে, সরকারের ত্বরিত হস্তক্ষেপ ছাড়া শিল্পের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হতে পারে। বিশেষত MSME খাতের জন্য স্বল্পমেয়াদি প্রণোদনা এখন সময়ের দাবি। ভারত যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেয়, তবে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি আরও বেড়ে যাবে।