ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সাংসদ তেজস্বী সূর্যা (Tejasvi Surya) সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক নীতি ও আর্থিক সংস্কারের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তাঁর মতে, গত এক দশকে ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে ব্যাপকভাবে সম্পদ সৃষ্টির যে ধারা গড়ে উঠেছে, তা পর্যাপ্তভাবে স্বীকৃতি পায়নি।
এক্স (পূর্বতন টুইটার)-এ একটি পোস্টে সূর্যা লেখেন, “মোদি সরকারের মধ্যবিত্তদের জন্য যে পরিমাণ সম্পদ সৃষ্টি করেছে, তা যথাযথভাবে স্বীকৃতি পায়নি।” এই মন্তব্যের সঙ্গে একটি পরিসংখ্যান চিত্রও জুড়ে দেন তিনি, যেখানে গত দশকে ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট, মিউচুয়াল ফান্ড বিনিয়োগকারী এবং এসেটস আন্ডার ম্যানেজমেন্ট (AUM)-এর অগ্রগতির স্পষ্ট চিত্র উঠে এসেছে।
আর্থিক পরিসংখ্যান যা সূর্যার দাবিকে সমর্থন করে:
সূর্যার শেয়ার করা তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে যেখানে ডিম্যাট অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল ২.৫ কোটির মতো, ২০২৫ সালে তা পৌঁছেছে ১৯.৭ কোটিতে — যা ৭.৯ গুণ বৃদ্ধি। একইসঙ্গে, ইউনিক মিউচুয়াল ফান্ড বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ২০১৪ থেকে মে ২০২৫ পর্যন্ত বেড়েছে ৫.৫ গুণ।
অন্যদিকে, মিউচুয়াল ফান্ডের এসেটস আন্ডার ম্যানেজমেন্ট (AUM) ২০১৫ সালের মার্চে ছিল মাত্র ৮ লাখ কোটি টাকা, যা ২০২৫ সালের মে মাসে পৌঁছেছে ৭২.২ লাখ কোটি টাকায় — ৯ গুণের বেশি বৃদ্ধি।
বাজার মূলধনেও (market capitalisation) দেখা গেছে এক বিশাল উল্লম্ফন। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে যেখানে এটি ছিল ₹৭৪.২ লাখ কোটি, ২০২৫ সালের মে মাসে তা দাঁড়িয়েছে ₹৪৪৪.২ লাখ কোটিতে।
এই পরিসংখ্যানগুলোর উৎস হিসাবে সূর্যা উল্লেখ করেন ভারতের শীর্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থা SEBI (সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া)।
সূর্যার বিশ্লেষণ ও দর্শন:
তেজস্বী সূর্যার মতে, এই আর্থিক অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি ছিল সাধারণ নাগরিকদের, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির, আর্থিক বাজারে সক্রিয় অংশগ্রহণ। তিনি বলেন, “আমরা যারা গত দশকে বিনিয়োগ শুরু করেছি, তাদের মতো লাখ লাখ মানুষ এখন বাজারের সঙ্গে জড়িত।”
তিনি আরও যোগ করেন, “স্টক ব্রোকিং সংস্থার সংখ্যা বেড়েছে হাজার হাজার। ফলে একটি সম্পূর্ণ নতুন প্রজন্ম পুঁজিবাজারের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। এটি শুধু অর্থনীতির জন্য নয়, সাধারণ মানুষের আর্থিক স্বস্তির জন্যও ইতিবাচক দিক।”
সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও বিতর্ক:
সূর্যার এই বক্তব্য ও পরিসংখ্যান ঘিরে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ কেউ প্রশংসা করেছেন, আবার কেউ সমালোচনাও করেছেন।
এক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “ব্যাঙ্গালোর বা মুম্বাইয়ের মতো শহরের মধ্যবিত্তদের জন্য আলাদা স্কিম থাকা উচিত। এখানে জীবনযাত্রার খরচ এত বেশি যে আয় থেকেও সঞ্চয় সম্ভব হয় না।”
অন্য একজন ব্যবহারকারী বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে লেখেন, “যদি সরকার কিছু নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়, তাহলে সাধারণ বিনিয়োগকারী আরও বেশি উৎসাহিত হবেন। এতে বিনিয়োগ কয়েকগুণ বেড়ে যেতে পারে।”
তবে সমালোচনাও এসেছে খোলামেলাভাবে। এক ব্যবহারকারী প্রশ্ন তোলেন, “LTCG বা STCG-এর পাশাপাশি কেন এখনও STT (সিকিউরিটিজ ট্রানজাকশন ট্যাক্স) দিতে হয়?”
আরেকজন লেখেন, “সব কিছু গ্রাফে ভালো দেখায়। বাস্তবে মধ্যবিত্তদের হাতে কিছুই থাকে না। সব টাকা EMI, সুদ আর GST-তে চলে যায়।”
বিশ্লেষণ: আসল চিত্র কতটা উজ্জ্বল?
অবশ্য সূর্যার দাবি কিছুটা যথার্থ হলেও, এর ব্যাখ্যা অনেক জটিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, পুঁজিবাজারে মধ্যবিত্তের অংশগ্রহণ বাড়লেও সেটা সার্বিক অর্থনৈতিক সুরক্ষার প্রতীক নয়। ভারতে এখনও অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার উচ্চ জীবনযাত্রার ব্যয়, ঋণের দায়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যয়ের চাপের মধ্যে রয়েছে।
অন্যদিকে, যেসব মানুষ নিয়মিত SIP, স্টক ইনভেস্টমেন্ট বা মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করছেন, তাঁদের আর্থিক সচেতনতা নিঃসন্দেহে বেড়েছে। কিন্তু সেই সচেতনতা সঞ্চয়ের সুরক্ষা নিশ্চয়তা দিতে পারছে কি না, তা নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট বিতর্ক।
তেজস্বী সূর্যার বক্তব্য নিঃসন্দেহে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। মোদি সরকারের অর্থনৈতিক রূপান্তরের ফলে পুঁজিবাজারে মধ্যবিত্তদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে — এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
তবে এই অংশগ্রহণের বাস্তব প্রভাব, নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব নিয়ে এখনও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। মধ্যবিত্তের হাতে বিনিয়োগ বাড়ছে, কিন্তু সেই বিনিয়োগ কতটা লাভজনক ও নিরাপদ, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব এখনও সরকারের কাঁধে।