খবর এক নজরে
সম্প্রতি একটি রেডিট পোস্ট প্রযুক্তি জগতে বিতর্কের ঝড় তুলেছে। একজন রেডিট ব্যবহারকারী দাবি করেছেন যে, তিনি একটি আমেরিকান টেক (US tech) কোম্পানির গোপনীয় নিয়োগ সংক্রান্ত নথি হাতে পেয়েছেন। গত দুদিন আগে প্রকাশিত এই নথি কোম্পানির কঠোর প্রার্থী নির্বাচন প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করে এবং প্রযুক্তি জগতে অভিজাততন্ত্র ও বৈষম্যের অভিযোগ তুলেছে। এই নথিতে ইন্টেল, সিসকো, এইচপি, টিসিএস, টাটা, মাহিন্দ্রা, ইনফোসিস, ক্যাপজেমিনি, ডেল, কগনিজেন্ট এবং উইপ্রোর মতো কোম্পানিতে কাজ করা ব্যক্তিদের ‘অযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ঘটনা ভারতীয় প্রযুক্তি পেশাদারদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
নথিতে কী আছে?
রেডিটে ফাঁস হওয়া এই নথি অনুসারে, উল্লিখিত কোম্পানিগুলোতে কাজ করা ব্যক্তিদের এই আমেরিকান টেক কোম্পানির নিয়োগ মানদণ্ডের জন্য ‘উপযুক্ত নয়’ বলে মনে করা হয়। এই ‘ব্ল্যাকলিস্ট’ তালিকায় ভারতের শীর্ষস্থানীয় আইটি কোম্পানি যেমন টিসিএস, ইনফোসিস, উইপ্রো এবং টাটার নাম রয়েছে। এছাড়াও, এইচপি, ডেল এবং ইন্টেলের মতো বৈশ্বিক প্রযুক্তি জায়ান্টদেরও এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নথিতে বলা হয়েছে, এই কোম্পানিগুলোর কর্মীদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রত্যাশা পূরণ করে না। এই দাবি প্রযুক্তি জগতে তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক পেশাদারদের জন্য বিধিনিষেধ
নথিতে আরও উল্লেখ রয়েছে যে, এই কোম্পানি ভিসা স্পনসরশিপ প্রদান করবে না। ফলে শুধুমাত্র আমেরিকার নাগরিক, স্থায়ী বাসিন্দা এবং কানাডিয়ানরা এই চাকরির জন্য আবেদন করতে পারবেন। এই নীতি ভারত সহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রতিভাবান পেশাদারদের জন্য দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। এই বিধিনিষেধকে অনেকে প্রযুক্তি শিল্পে বৈষম্যমূলক আচরণ হিসেবে দেখছেন।
অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রির শর্ত
নথি অনুসারে, প্রার্থীদের অবশ্যই এমআইটি, স্ট্যানফোর্ড, কার্নেগি মেলন, ইউসি বার্কলে, ক্যালটেক, ইউআইইউসি এবং ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াটারলুর মতো শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকতে হবে। এছাড়া, প্রার্থীদের চার থেকে দশ বছরের সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট অভিজ্ঞতা এবং আধুনিক জাভাস্ক্রিপ্ট ফ্রেমওয়ার্ক যেমন টাইপস্ক্রিপ্ট, নোডজেএস, রিঅ্যাক্টজেএস এবং এআই/এলএলএম-এর সঙ্গে পরিচিতি থাকা আবশ্যক। এই কঠোর মানদণ্ড অনেক যোগ্য প্রার্থীকে বাদ দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ভাইরাল প্রতিক্রিয়া ও শিল্পের সমালোচনা
রেডিটে এই নথি ফাঁস করা ব্যবহারকারী কোম্পানির এই নিয়োগ নীতিকে ‘অহংকারী ও অভিজাততান্ত্রিক’ বলে সমালোচনা করেছেন। তিনি নিজে এই মানদণ্ডের বেশিরভাগ পূরণ করলেও, এই নীতিকে বৈষম্যমূলক মনে করেন। এই পোস্টটি দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায় এবং অনেকে তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। একজন ব্যবহারকারী লেখেন, “আমি একটি বড় কোম্পানিতে কাজ করি এবং বছরের পর বছর ধরে টেক শিল্পে প্রবেশের চেষ্টা করছি, কিন্তু তারা শুধু নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়োগ করে।” এই মন্তব্য অনেকের মনে সাড়া জাগিয়েছে এবং ক্ষোভ আরও বাড়িয়েছে।
একজন প্রাক্তন এল৭ ফেসবুক ইঞ্জিনিয়ার এই বিষয়ে মন্তব্য করে বলেন, শীর্ষস্থানীয় কম্পিউটার সায়েন্স স্কুলগুলো থেকে নিয়োগ করা টেক শিল্পে অস্বাভাবিক নয়। তিনি জানান, এই স্কুলগুলো প্রাথমিক পর্যায়ের টেক চাকরির জন্য প্রধান পাইপলাইন হিসেবে কাজ করে। তবে এই মন্তব্য বিতর্ককে আরও উস্কে দিয়েছে।
নথি কি নকল না সত্যি?
অনেকে এই নথির প্রকাশে ক্ষুব্ধ হলেও, কেউ কেউ এর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তারা রেডিট ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে নথিটি জাল করার অভিযোগ তুলেছেন। তবে, ‘কোডিংবুটক্যাম্প’ সাবরেডিটের মডারেটর এবং প্রাক্তন ফেসবুক কর্মী মাইকেল নোভাতি এই ব্যবহারকারীর পক্ষে কথা বলেন। তিনি জানান, মূল পোস্টে অতিরিক্ত গোপনীয় প্রমাণ ছিল যা নথির সত্যতার পক্ষে সমর্থন করে। নোভাতি বলেন, “আমার অনুমান, এটি নকলের চেয়ে সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।” যদিও তিনি স্বীকার করেন যে, এটি সম্পূর্ণরূপে যাচাই করা সম্ভব নয়।
টেক শিল্পে পক্ষপাতমূলক নিয়োগ প্রথা?
এই বিতর্ক টেক শিল্পে প্রবেশের ক্ষেত্রে অনেকের মুখোমুখি হওয়া অসুবিধাগুলোকে সামনে এনেছে। এই ঘটনা শিল্পের মধ্যে পক্ষপাতমূলক নিয়োগ প্রথা এবং ক্রমবর্ধমান একচেটিয়াতার বিষয়ে উদ্বেগ তুলেছে। দীর্ঘদিন ধরে টেক শিল্পের সমালোচনা হয়ে আসছে যে, এটি অভিজাত স্কুল এবং কোম্পানিগুলোর প্রতি পক্ষপাত করে। এই নথি সেই অভিযোগকে আরও জোরালো করেছে।
ভারতের আইটি পেশাদারদের জন্য এই ঘটনা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। টিসিএস, ইনফোসিস, উইপ্রো এবং টাটার মতো কোম্পানিগুলো বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এই কোম্পানিগুলোর কর্মীদের ‘অযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা ভারতীয় প্রযুক্তি পেশাদারদের দক্ষতা ও অবদানের প্রতি অবমাননা বলে অনেকে মনে করছেন।
শিল্পে প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ প্রভাব
এই ঘটনা প্রযুক্তি শিল্পে বৈষম্য ও সুযোগের অভাব নিয়ে আলোচনাকে নতুন করে জাগিয়েছে। অনেকে মনে করেন, এই ধরনের নিয়োগ নীতি শিল্পের বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। একজন রেডিট ব্যবহারকারী লিখেছেন, “এই ধরনের নীতি আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য টেক শিল্পে প্রবেশের পথ বন্ধ করে দেয়।” আরেকজন যোগ করেন, “এটি শুধু অভিজাততন্ত্র নয়, এটি প্রতিভার অপচয়।”
এই বিতর্কের প্রেক্ষিতে, অনেকে প্রযুক্তি শিল্পের নিয়োগ প্রক্রিয়ার পুনর্মূল্যায়নের দাবি তুলেছেন। তারা বলছেন, শিল্পকে আরও স্বচ্ছ, ন্যায্য এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে হবে। ভারতীয় আইটি পেশাদারদের মধ্যে এই ঘটনা ক্ষোভ সৃষ্টি করলেও, অনেকে আশা করছেন যে, এটি শিল্পে ইতিবাচক পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করবে।
এই ফাঁস হওয়া নথির সত্যতা যাচাই করা সম্ভব না হলেও, এটি যে আলোচনা শুরু করেছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তি শিল্পে প্রবেশের পথে বাধা, পক্ষপাতমূলক নিয়োগ প্রথা এবং বৈষম্যের বিষয়গুলো এখন সামনে এসেছে। ভারতের প্রযুক্তি পেশাদারদের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জ, কিন্তু একই সঙ্গে এটি শিল্পকে আরও ন্যায্য করার একটি সুযোগও হতে পারে। এই ঘটনা শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়োগ নীতির উপর কী প্রভাব ফেলবে, তা দেখার জন্য বিশ্ব অপেক্ষা করছে।