আধুনিক জীবনযাত্রার সুবিধার জন্য স্মার্ট হোম প্রযুক্তি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে (Smart Home)। স্মার্ট স্পিকার, স্মার্ট টিভি, স্মার্ট থার্মোস্ট্যাট, সিকিউরিটি ক্যামেরা এবং এমনকি স্মার্ট রেফ্রিজারেটরের মতো ডিভাইসগুলি আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে আরও আরামদায়ক ও দক্ষ করে তুলছে। কিন্তু এই সুবিধার পিছনে লুকিয়ে রয়েছে একটি গুরুতর উদ্বেগ গোপনীয়তার লঙ্ঘন।
আন্তর্জাতিক গবেষণা এবং সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, স্মার্ট হোম ডিভাইসগুলি ব্যবহারকারীর অজান্তে তথ্য সংগ্রহ করে তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে, যা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার জন্য মারাত্মক হুমকি।
এই বিষয়টি সম্প্রতি এক্স প্ল্যাটফর্মে ‘স্মার্ট হোম প্রাইভেসি ইস্যু’ হিসেবে ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে।হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার মতো, সাইবার নিরাপত্তা গবেষকরাও স্মার্ট হোম ডিভাইসের গোপনীয়তা লঙ্ঘনের বিষয়টি তুলে ধরেছেন।
এইচআরডব্লিউ-এর রিপোর্টে ভারতের বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে বাংলাভাষী মানুষের উপর নির্যাতনের বিষয়টি আলোচিত হয়েছে, তবে স্মার্ট হোম প্রযুক্তির গোপনীয়তা লঙ্ঘন একটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা। গবেষণায় দেখা গেছে, স্মার্ট ডিভাইসগুলি ক্যামেরা, মাইক্রোফোন এবং সেন্সরের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য, যেমন অবস্থান, কথোপকথন, এমনকি দৈনন্দিন অভ্যাস, সংগ্রহ করে।
উদাহরণস্বরূপ, অ্যামাজনের রিং ভিডিও ডোরবেল এবং গুগল নেস্টের ক্যামেরাগুলি ব্যবহারকারীর ভিডিও ফুটেজ তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছে, যা মার্কিন কংগ্রেসে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।নিউ ইয়র্কের ট্যান্ডন স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ইএমডিইএ নেটওয়ার্কসের একটি গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে যে, স্মার্ট হোম ডিভাইসগুলি স্থানীয় নেটওয়ার্ক প্রোটোকলের মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করে, যেমন ডিভাইসের নাম, ইউনিক আইডেন্টিফায়ার (ইউইউআইডি) এবং গৃহস্থলীর অবস্থান।
এই তথ্যগুলি সংগ্রহ করে বিজ্ঞাপন সংস্থা এবং সাইবার অপরাধীরা ব্যবহারকারীদের শনাক্ত করতে পারে, যা গোপনীয়তার জন্য মারাত্মক ঝুঁকি। গবেষণায় বলা হয়েছে, “একটি স্মার্ট হোমের তিনটি শনাক্তকারী তথ্য একত্রিত করলে এটি ১১.২ লক্ষ স্মার্ট হোমের মধ্যে একটি হিসেবে শনাক্ত হয়।” এই তথ্য সংগ্রহের জন্য ব্যবহারকারীর সম্মতি প্রায়শই নেওয়া হয় না, যা ইউরোপের জিডিপিআর এবং ভারতের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইনের লঙ্ঘন।
এক্স প্ল্যাটফর্মে এই বিষয়ে আলোচনা তীব্র হয়েছে। একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, “স্মার্ট টিভি, অ্যালেক্সা, এমনকি স্মার্ট রেফ্রিজারেটরও আপনার তথ্য সংগ্রহ করে এবং তৃতীয় পক্ষের কাছে পাঠায়। এটি একটি অদৃশ্য নজরদারি ব্যবস্থা।” আরেকজন ব্যবহারকারী মন্তব্য করেছেন, “আপনার স্মার্ট হোম ডিভাইসগুলি শুধু আপনাকে নয়, আপনার পুরো পরিবারের আচরণ, মেজাজ এবং ঝুঁকি ট্র্যাক করে।”
এই ধরনের উদ্বেগগুলি স্মার্ট হোম প্রযুক্তির সুবিধার পাশাপাশি এর ঝুঁকিগুলিকে তুলে ধরছে।স্মার্ট হোম ডিভাইসগুলির মাধ্যমে গোপনীয়তা লঙ্ঘনের মধ্যে রয়েছে ডেটা চুরি, ডিভাইস হাইজ্যাকিং, এবং ম্যান-ইন-দ্য-মিডল (এমআইটিএম) আক্রমণ।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালে ভেরকাডা সিকিউরিটি ক্যামেরার হ্যাকের ঘটনায় ১৫০,০০০ ক্যামেরার ফুটেজ ফাঁস হয়েছিল। এছাড়া, ২০১৯ সালে ভিজিও কোম্পানি দর্শকদের সম্মতি ছাড়া তাদের টিভি দেখার অভ্যাস ট্র্যাক করার জন্য ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জরিমানার মুখোমুখি হয়েছিল।
এই ঘটনাগুলি প্রমাণ করে যে, স্মার্ট ডিভাইসগুলি প্রায়শই ব্যবহারকারীর অজান্তে তথ্য সংগ্রহ করে এবং তা বিজ্ঞাপন সংস্থা, সরকারি সংস্থা, এমনকি বিদেশি সংস্থার কাছে পৌঁছে যায়।গোপনীয়তা রক্ষার জন্য বিশেষজ্ঞরা বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। প্রথমত, ব্যবহারকারীদের ডিভাইসের গোপনীয়তা নীতি ভালোভাবে পড়া উচিত এবং ডেটা সংগ্রহের বিকল্প বন্ধ করা উচিত।
দ্বিতীয়ত, শক্তিশালী এবং অনন্য পাসওয়ার্ড এবং দ্বি-স্তরীয় প্রমাণীকরণ (২এফএ) ব্যবহার করা উচিত। তৃতীয়ত, ডিভাইসের ফার্মওয়্যার নিয়মিত আপডেট করা এবং অপ্রয়োজনীয় ফিচার বন্ধ করা উচিত। এছাড়া, স্মার্ট হোম নেটওয়ার্ককে প্রধান নেটওয়ার্ক থেকে আলাদা করা এবং ফায়ারওয়াল ব্যবহার করা হ্যাকিংয়ের ঝুঁকি কমাতে পারে।
তিনি বলেন, “আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা উচিত। প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে সহজ করবে, কিন্তু এটি আমাদের গোপনীয়তার উপর আঘাত হানতে পারে না।” তিনি নাগরিকদের সতর্ক থাকার এবং সরকারের সঙ্গে এই বিষয়ে সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়েছেন।
ডার্বিতে পেত্রাতোস ইস্যুতে মুখ খুললেন সায়ন! জানালেন আসল ঘটনা
স্মার্ট হোম প্রযুক্তির সুবিধা অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত গোপনীয়তার ঝুঁকি আমাদের সতর্ক হতে বাধ্য করছে। নির্মাতাদের স্বচ্ছ নীতি এবং কঠোর গোপনীয়তা আইনের মাধ্যমে এই সমস্যা মোকাবিলা করা জরুরি।