ভারতের প্রধান তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি তাতা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস (TCS) পশ্চিমবঙ্গে একটি বড় উন্নয়নের পথে এগিয়ে গেছে। গতকাল, ২৫ জুন, নিউ টাউন কলকাতা ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (NKDA) TCS-এর নতুন ক্যাম্পাসের প্রথম পর্যায়ের নির্মাণ পরিকল্পনা অনুমোদন করে দিয়েছে, যা বেঙ্গল সিলিকন ভ্যালির মাঝে ২০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে। এই ক্যাম্পাসটি প্রায় ২৫,০০০টি নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করবে, যা পশ্চিমবঙ্গের তরুণ প্রজন্মের জন্য একটি বড় আশার রশ্মি হয়ে উঠেছে।
প্রকল্পের বিস্তারিত ও বৈশিষ্ট্য
এই নতুন ক্যাম্পাসটি ২৪ লক্ষ বর্গফুট এলাকায় বিস্তৃত হবে এবং এটি বেঙ্গল সিলিকন ভ্যালি টেক হাব-এর একটি অংশ হিসেবে গড়ে উঠবে। বেঙ্গল সিলিকন ভ্যালি নিউ টাউনের অ্যাকশন এরিয়া-২-এ প্রায় ২০০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, যা কলকাতা বিমানবন্দর থেকে মাত্র দশ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত। এই অঞ্চলটি ইতিমধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি ও আইটিইএস (IT/ITeS) উদ্যোগের জন্য একটি আদর্শ স্থান হিসেবে গণ্য হচ্ছে। TCS-এর এই ক্যাম্পাসটি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্মিত হবে, যেখানে ৭৪% শক্তি পুনর্জননযোগ্য উৎস থেকে সংগ্রহ করা হবে এবং ১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রুফটপ সোলার প্যানেলের মাধ্যমে উৎপাদন করা হবে। এই উদ্যোগটি শুধুমাত্র চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করবেই না, বরং রাজ্যের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রকল্পকে রাজ্যের জন্য একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের তরুণদের জন্য উন্নয়নের সুযোগ তৈরি করতে চাইছি। TCS-এর এই পদক্ষেপ আমাদের সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবে।” এই ক্যাম্পাসটি শুধুমাত্র স্থানীয় তরুণদের জন্য নয়, বরং বৈশ্বিক প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর জন্যও কলকাতাকে একটি আকর্ষণীয় কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে।
পশ্চিমবঙ্গের শিল্প উন্নয়নে নতুন দিশা
পশ্চিমবঙ্গের শিল্প উন্নয়নের ইতিহাস সবসময়ই বিতর্কিত। বিশেষ করে ২০০৬ সালে সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ প্রকল্পের বিরোধিতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তা রাজ্যের শিল্প উন্নয়নে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের শাসকদল এবং শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে একটি ইতিহাস পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে। TCS-এর এই নতুন ক্যাম্পাস সেই পরিবর্তনের একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে।
TCS-এর এই প্রকল্পটি তার জাতীয় বিস্তার কৌশলের অংশ। কোম্পানিটি ইতিমধ্যে বেঙ্গালুরু, কোচি, হায়দ্রাবাদ, কোয়িম্বতোর এবং বিশাখাপত্তনমের মতো শহরগুলোতে তার কার্যক্ষেত্র প্রসারিত করেছে। বেঙ্গল সিলিকন ভ্যালি TCS-এর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হয়ে উঠবে, যা ভারতের প্রযুক্তি খাতে এর অবদান আরও বাড়াবে। বর্তমানে TCS ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম নিয়োগকর্তা হিসেবে পরিচিত, যেখানে ৬.১২ লক্ষ কর্মী কাজ করছেন। ২০২৫ সালের ট্রেড ব্রেইন্স রিপোর্ট অনুযায়ী, রক্ষণাবেক্ষণ মন্ত্রণালয় (২৯.৯ লক্ষ) এবং ভারতীয় রেলওয়ে (১২.১ লক্ষ) এই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে।
চাকরির গুণমান ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
যদিও ২৫,০০০টি চাকরির সম্ভাবনা উত্তেজনাপূর্ণ, তবুও দীর্ঘমেয়াদী চাকরির গুণমান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। ২০২৩ সালের একটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সাপ্তাহিক পত্রিকার গবেষণায় দেখা গেছে যে, আইটি খাতে বেতন স্থিরতা এবং কর্মীদের কাজের চাপ একটি উদ্বেগের বিষয়। এই প্রকল্পের সাফল্য নির্ভর করবে এর ওপর যে, TCS কীভাবে তাদের কর্মীদের জন্য একটি ভাল কাজের পরিবেশ তৈরি করতে পারে এবং যুবশক্তির দক্ষতা উন্নয়নে কতটা গুরুত্ব দেবে। স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ালে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
TCS-এর এই নতুন ক্যাম্পাস পশ্চিমবঙ্গের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এটি শুধুমাত্র চাকরির সুযোগই সৃষ্টি করছে না, বরং রাজ্যকে একটি আধুনিক প্রযুক্তি কেন্দ্র হিসেবে মানচিত্রে স্থান করে নিচ্ছে। তবে এই উন্নয়নকে টেকসই এবং সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য করতে সরকার ও শিল্পক্ষেত্রের সমন্বয়ী প্রচেষ্টা অত্যন্ত প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গের তরুণ প্রজন্ম এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রাজ্যের ভবিষ্যৎ গড়তে পারে, যদি সঠিক নির্দেশনা এবং প্রশিক্ষণ পায়। এই প্রকল্পটি একটি নতুন শুরু হতে পারে, যা পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের শিল্প ও প্রযুক্তি মানচিত্রে আরও শক্তিশালী করে তুলবে।