টিসিএস কলকাতায় হাইব্রিড ওয়ার্ক পলিসির দাবি, ফাঁস হওয়া অভ্যন্তরীণ মেমো নিয়ে বিতর্ক

ভারতের বৃহত্তম আইটি পরিষেবা সংস্থা টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস (TCS) সম্প্রতি তাদের কর্মচারীদের জন্য কঠোর কাজের নীতি প্রয়োগ করেছে, যা কলকাতার কর্মচারীদের (TCS Kolkata) মধ্যে ব্যাপক…

TCS Kolkata Employees in working office

ভারতের বৃহত্তম আইটি পরিষেবা সংস্থা টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস (TCS) সম্প্রতি তাদের কর্মচারীদের জন্য কঠোর কাজের নীতি প্রয়োগ করেছে, যা কলকাতার কর্মচারীদের (TCS Kolkata) মধ্যে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। একটি ফাঁস হওয়া অভ্যন্তরীণ মেমো অনুসারে, টিসিএস তাদের সম্পূর্ণ হাইব্রিড কাজের নীতি বাতিল করে সকল কর্মচারীকে সপ্তাহে পাঁচ দিন অফিসে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। এই নির্দেশনা ২০২৩ সালের ১ অক্টোবর থেকে কার্যকর হয়েছে, যা অনেক কর্মচারী, বিশেষ করে কলকাতার টিসিএস কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতিতে, কলকাতার কর্মচারীরা হাইব্রিড ওয়ার্ক পলিসি ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন, যা তাদের কাজ এবং ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক হবে। এই প্রতিবেদনে আমরা এই বিতর্কের বিস্তারিত আলোচনা করব এবং কলকাতার কর্মচারীদের দাবির পটভূমি বিশ্লেষণ করব।

ফাঁস হওয়া মেমো এবং নতুন নীতি
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে, টিসিএস একটি অভ্যন্তরীণ মেমোর মাধ্যমে ঘোষণা করে যে সমস্ত কর্মচারীকে ১ অক্টোবর থেকে সপ্তাহে পাঁচ দিন অফিসে কাজ করতে হবে। এই মেমোতে উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এবং প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা (সিএইচআরও) বিভিন্ন টাউনহলে এই নির্দেশনার কথা জানিয়েছেন। এই নীতি টিসিএসের পূর্ববর্তী হাইব্রিড মডেল থেকে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন, যেখানে কর্মচারীদের সপ্তাহে তিন দিন অফিসে এবং বাকি দিন বাড়ি থেকে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হতো। ফাঁস হওয়া এই মেমোটি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, এবং কলকাতার কর্মচারীরা এই নীতির বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

   

মেমো অনুসারে, টিসিএস তাদের প্রাক-মহামারী কাজের সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে চায়, যেখানে অফিসে উপস্থিতি, সহযোগিতা, এবং সাংগঠনিক সংস্কৃতি বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। তবে, কর্মচারীরা দাবি করছেন যে হাইব্রিড মডেল তাদের উৎপাদনশীলতা এবং কাজের নমনীয়তা বজায় রাখতে সহায়ক ছিল। কলকাতার টিসিএস কর্মচারীদের মতে, শহরের ট্রাফিক সমস্যা এবং দীর্ঘ যাতায়াতের সময়ের কারণে প্রতিদিন অফিসে যাওয়া তাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং।

কর্মচারীদের দাবি এবং কারণ
কলকাতার টিসিএস কর্মচারীরা হাইব্রিড ওয়ার্ক পলিসির পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছেন, যা তাদের বাড়ি থেকে কাজ করার সুযোগ দেবে। সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মে, বিশেষ করে এক্স-এ, কর্মচারীরা তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন এবং জানিয়েছেন যে প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার ফলে তাদের কাজের-জীবনের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। একজন কর্মচারী লিখেছেন, “কলকাতায় ট্রাফিক এবং দীর্ঘ যাতায়াতের সময় আমাদের দিনের একটি বড় অংশ নষ্ট করে। হাইব্রিড মডেল আমাদের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছিল, কিন্তু এখন আমরা আবার পিছিয়ে যাচ্ছি।”

২০২৪ সালে টিসিএস আরও কঠোর নীতি প্রয়োগ করে, যেখানে কর্মচারীদের অফিসে উপস্থিতির সাথে তাদের পরিবর্তনশীল বেতন (ভেরিয়েবল পে) সংযুক্ত করা হয়েছে। নতুন নীতি অনুসারে, যারা ৬০% এর কম সময় অফিসে উপস্থিত থাকেন, তারা কোনো ভেরিয়েবল পে পাবেন না। ৬০-৭৫% উপস্থিতির জন্য ৫০%, ৭৫-৮৫% এর জন্য ৭৫%, এবং ৮৫% এর বেশি উপস্থিতির জন্য সম্পূর্ণ ভেরিয়েবল পে দেওয়া হবে। এই নীতি কলকাতার কর্মচারীদের মধ্যে আরও অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে, কারণ অনেকে মনে করেন এটি তাদের আর্থিক ক্ষতির কারণ হতে পারে।

কলকাতার প্রেক্ষাপট
কলকাতা শহরে ট্রাফিক সমস্যা এবং দীর্ঘ যাতায়াতের সময় কর্মচারীদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। টিসিএসের সল্টলেক এবং নিউটাউনের অফিসে প্রতিদিন যাতায়াত করতে অনেক কর্মচারীকে ১-২ ঘণ্টা সময় ব্যয় করতে হয়। এছাড়া, কলকাতার আবহাওয়া, বিশেষ করে বর্ষাকালে, যাতায়াতকে আরও কঠিন করে তোলে। ফলে, কর্মচারীরা হাইব্রিড মডেলের পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন, যা তাদের সপ্তাহে কয়েকদিন বাড়ি থেকে কাজ করার সুযোগ দেবে।

এক্স প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত পোস্ট অনুসারে, কলকাতার অনেক কর্মচারী টিসিএসের এই নীতিকে “কর্মচারী-বিরোধী” বলে অভিহিত করেছেন। তারা দাবি করছেন যে হাইব্রিড মডেল শুধুমাত্র তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করেনি, বরং কোম্পানির উৎপাদনশীলতাও বাড়িয়েছে। একজন কর্মচারী লিখেছেন, “কোভিড-১৯ মহামারীর সময় আমরা বাড়ি থেকে কাজ করে টিসিএসের লক্ষ্য পূরণ করেছি। তাহলে এখন কেন আমাদের জোর করে অফিসে ফিরতে হবে?”

Advertisements

টিসিএসের যুক্তি এবং শিল্পের প্রেক্ষাপট
টিসিএসের প্রধান অপারেটিং কর্মকর্তা এনজি সুব্রামানিয়াম বলেছেন, “অফিসে ফিরে আসা আমাদের সাংগঠনিক সংস্কৃতি এবং সহযোগিতা বজায় রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মহামারীর সময় অনেক কর্মচারী অনলাইনে যোগদান করেছেন এবং অফলাইন মিথস্ক্রিয়ার অভাবে তাদের সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ কম ছিল।” তিনি আরও বলেন, “আমরা ধৈর্য ধরে চেষ্টা করছি, তবে কর্মচারীদের অফিসে ফিরতে হবে।”

তবে, টিসিএসের এই নীতি অন্যান্য আইটি সংস্থার তুলনায় কঠোর। ইনফোসিস এবং উইপ্রোর মতো সংস্থাগুলি এখনও সপ্তাহে ২-৩ দিন অফিসে কাজের হাইব্রিড মডেল অনুসরণ করছে। এই পার্থক্য টিসিএসের কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়িয়েছে, এবং অনেকে অন্য সংস্থায় চাকরি খোঁজার কথা ভাবছেন যেখানে হাইব্রিড মডেল রয়েছে।

সম্ভাব্য প্রভাব
টিসিএসের এই কঠোর নীতির ফলে কর্মচারীদের মধ্যে প্রত্যাহার (অ্যাট্রিশন) বাড়তে পারে। ২০২৩ সালে, টিসিএসের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে মহিলা কর্মচারীদের প্রত্যাহারের হার পুরুষদের তুলনায় বেশি, যা হাইব্রিড মডেল বাতিলের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে। কলকাতার কর্মচারীরা, যাদের মধ্যে অনেকেই পরিবারের দায়িত্ব পালন করেন, মনে করেন যে হাইব্রিড মডেল তাদের জন্য বেশি উপযোগী।

এছাড়া, টিসিএসের নীতি কলকাতার ট্রাফিক এবং পরিবহন ব্যবস্থার উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। সামাজিক মাধ্যমে অনেকে মন্তব্য করেছেন যে পাঁচ দিন অফিসে যাওয়ার ফলে কলকাতার রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম বাড়বে। এটি শুধুমাত্র কর্মচারীদের জন্যই নয়, সাধারণ নাগরিকদের জন্যও সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

টিসিএস কলকাতার কর্মচারীদের হাইব্রিড ওয়ার্ক পলিসির দাবি এবং ফাঁস হওয়া মেমোর বিতর্ক আইটি শিল্পে কাজের নমনীয়তার গুরুত্ব তুলে ধরেছে। যদিও টিসিএস তাদের সাংগঠনিক সংস্কৃতি এবং সহযোগিতার উপর জোর দিচ্ছে, কর্মচারীরা মনে করছেন যে হাইব্রিড মডেল তাদের উৎপাদনশীলতা এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছে। কলকাতার ট্রাফিক এবং যাতায়াতের চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষিতে, হাইব্রিড মডেল ফিরিয়ে আনা কর্মচারীদের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে। টিসিএসের এই নীতি ভবিষ্যতে কর্মচারী প্রত্যাহার এবং শিল্পের প্রতিযোগিতার উপর কী প্রভাব ফেলবে, তা দেখার বিষয়।